সুলতানা বলল, সত্যি সই, ওর চিঠি পেয়ে এক এক সময় কি মনে হয় জানিস?
কি?
যদি আমাদের বিয়ে হয়ে যেত, তা হলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ওর কাছে চলে যেতাম। ওকে আজ চার বছর দেখিনি। ওর কথা মনে পড়লে আমি স্থির থাকতে পারি না। তুই তো আমাদের সব কথা জানিস। তোকে তো আমি কোনো কিছু গোপন করি নি। এই নে পড়ে দেখ বলে চিঠিটা তার হাত দিয়ে রুমালে চোখ মুছল।
লাইলী তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগল।
সুলতানা, প্রেয়সী আমার,
গতকাল তোমার নরম তুলতুলে হাতের লেখা পত্র আমাকে নবজন্ম দান করেছে। তোমার নাম সার্থক। সত্যি তুমি সম্রাজ্ঞী। তবে কোনো দেশের নয়, আমার হৃদয় রাজ্যের। আমার চিঠি পাওয়ার ডেট ওভার হয়ে যেতে তুমি থাকতে না পেরে আমাকে চিঠি দিয়েছ। খুব অভিমান হয়েছে না? হবারই কথা। কিন্তু না দেওয়ার কারণটা জানলে অভিমান কী রাখতে পারবে? আমার টাইফয়েড হয়েছিল। আজ পঁচিশ দিন পর ভাত খেলাম। যোহরের নামায পড়ে তোমাকে চিঠি লিখছি। আগেও তোমাকে অসুখের কথা জানাতে পারতাম, তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে, সামনে পরীক্ষা, তাই জানাইনি। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ভালো হয়ে পত্র দিলাম। এবার আর আমার হৃদয়ের রানীর অভিমান নিশ্চিয় নেই? অসুখের সময় তোমাকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু বিধির বিধান লংঘন করবে কে? তোমাকে কাছে পেতে অনেক বাধা। তাই আল্লাহপাকের কাছে সাহায্য চেয়ে সবর করছি। এবার দেশে ফিরে দেখব কেমন করে তুমি দূরে থাক। জান, তোমাকে চিঠি লিখতে বসলে এক সঙ্গে অনেক কথা এসে ভীড় করে। কোনটা লিখব, না লিখবো ঠিক করতে না পেরে শেষে সব গুলিয়ে যায়। তোমার স্মৃতি আমার তনু-মনুর সঙ্গে মিশে রয়েছে। যদিও জানি তুমি আমার, তবু মনে হয় তোমাকে পাব তো?
ছুটির দিন হোষ্টেলের সব ছেলেরা কত জায়গায় বেড়াতে যায়। আমার যেতে মন চায় না। একদিন বন্ধু জায়েদ ইবনে সাঈদ, সে সৌদি আরব থেকে এসেছে, জোর করে মিউজিয়াম ও চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে গেল। তার সঙ্গে গেলাম, সবকিছু দেখলাম; কিন্তু মনে শান্তি পেলাম না। আমার তখন মনে হয়েছে, তোমাকে সাথে না নিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আমাকে সে বলল, কিরে তুই অমন মন মরা হয়ে আছিস কেন? এটাই তো হেসে খেলে বেড়াবার সময়। আমি বললাম, সবাইকে সব সময় সব কিছু ভালো নাও লাগতে পারে।
জান, এখানে তো কত মেয়ে চোখে পড়ে, তাদেরকে দেখলে তোমার কথা আরও বেশি মনে পড়ে। সেইজন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি। একরাত্রে চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখলাম, তুমি হঠাৎ এখানে এসে গেছ। আমাকে রাত দুটো পর্যন্ত পড়তে দেখে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে ঘুম পাড়ালে। আমার তখন খুব ঘুম পেয়েছিল, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম তোমার কোলে নয় টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। এখন রাখি, অসুখ হয়ে পড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। পড়াশোনায় মন দেব। ভালো থেক, আমিও থাকার চেষ্টা করব। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি—
তোমার খালেদ।
লাইলী চিঠিটা ভাঁজ করে সুলতানার হাতে ফেরত দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি তোদের দুজনের কথা ভেবে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে আমিও কিছু কথা বলে তোর মনের দুঃখ লাঘব করতে পারি, যদি তুই কিছু খাওয়াস?
বেশতো খাওয়াব বল না কি কথা?
জানিস, আমি না বলে লাইলী মুখটা নিচু করে চুপ হয়ে গেল।
কি হল চুপ করে গেলি কেন? মাথা তুলবি তো বলে সুলতানা তার চিবুক ধরে তুলে দেখল, লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে গেছে। কিরে অত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি তো পুরুষ না।
আমি না একজনের প্রেমে পড়ে গেছি বলে লাইলী তাকে জড়িয়ে ধরল।
আরে পাগলি ছাড় ছাড়? কেউ দেখলে কি ভাববে বলতো?
লাইলী তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে দিল।
সুলতানা সোৎসাহে জিজ্ঞেস করল, কার প্রেমে পড়েছিস রে?
একটা ছেলের।
আর তাতো বুঝলাম, কিন্তু ছেলেটা কে? তার নাম কি সে কি করে। তার বাড়ি কোথায়?
থাম থাম, তোর অত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। যতটুকু জানি বলছি, ছেলেটার নাম সেলিম, এবছর স্ট্যাটিসটিক্স-এ অনার্স পরীক্ষা দিবে। বাড়ি গুলশানে।
ওমা তা হলে আমিওতো তাকে চিনি। ওরা আমাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। ওদের কেউ নামায রোযা তো করেই না, কলেমা জানে কিনা সন্দেহ। ওর আব্বা বলতো আলাহকে কী কেউ কোনোদিন দেখেছে যে, তার উপাসনা করব? আমার বয়স তখন দশ এগার হবে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, কি একটা ফ্যাংসানে ওদের বাড়িতে আব্বা-আম্মার সঙ্গে ছেলেবেলায় আমি একবার গিয়েছিলাম। আম্মাকে বোরখা পরা দেখে সকলে হেসেছিল। সেলিমের আব্বা তো সকলের সামনে আমাকে সালওয়ার কামিজ ও মাথায় ওড়না দেওয়া দেখে আবাকে বললেন, এযুগে আর ওসব পোষাক মানায় না। ঐসব ওল্ড মডেল। অত জামা কাপড় পরে থাকলে গায়ে আলো বাতাস লাগতে না পেরে অসুখ করবে। আব্বাও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, দেখুন আপনারা সব উচ্চ শিক্ষিত, আমি দু’একটা কথা বলতে চাই। জানি না কথাগুলো আপনাদের ভালো লাগবে কি না। আদিম যুগের মানুষ জঙ্গলে ও পাহাড়ের গুহায়ে বাস করত। তারা ন্যাংটা থাকত। যাদেরকে আমরা অসভ্য, জঙ্গলি ও বর্বর বলে থাকি। তারপর ক্রমান্বয়ে তারা গুহা ছেড়ে কুঁড়ে ঘরে বসবাস করতে শিখল এবং লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের ছাল ও পাতা ব্যবহার করত। আরও অনেক যুগ পরে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে আরম্ভ করল। তারা বুঝল শরীরের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে শরীরের আবরণ দরকার এবং লজ্জা স্থানগুলো ঢেকে রাখা দরকার। তাই তারা কাপড় তৈরি করে পরতে শিখল। কিন্তু আমরা আজ চরম সভ্যতা লাভ করে যদি সে আবরণ উম্মুক্ত করে শরীরের গোপন অংগের বেশিরভাগ সকলকে দেখিয়ে বেড়াই, তা হলে তো আবার আমরা সেই অসভ্য বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু তাও বা বলব কি করে সে যুগে নর-নারী সকলেই উলঙ্গ থাকত। কিন্তু বর্তমান যুগে নরেরা দিবি মাথায় হ্যাট, গলায় নেকটাই, পায়ে মোজা এবং ফুলপ্যন্ট ও ফুলশার্ট পরে শরীরের কোনো অংশই মেয়েদেরকে দেখাতে চায় না। অপর দিকে নারীকে অন্ধনগ্ন অবস্থায় সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নারীদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তারা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে বেড়াতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর সেই কারণে বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশে মেয়েদের কদর কমে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহর রাসূল (দঃ) মেয়েদেরকে কিমতি (দামী) জিনিস বলে উল্লেখ করেছেন। একটু বিবেচনা করলে বুঝতে পারবেন। কেউ দামি জিনিষকে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত করে ফেলে রাখে। ফেলে রাখলে তার কি অবস্থা হবে তা সকলেই জানে। ভালো জিনিস দেখলে কার লোভ হবে। যেই সুযোগ পাবে সেই হাত বাড়াবার চেষ্টা করবে। ফলে নানা রকম অশান্তির সৃষ্টি হবে। নারী স্বাধীনতার নাম করে মেয়েরা যে সর্বক্ষেত্রে পর্দা না মেনে যত্রতত্র অবাধ বিচরণ করছে, তার ফলাফল যে কত বিষময়, তা তো অহরহ গ্রামে গঞ্জে ও শহরে এবং খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আপনারা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখুন। আধা চুপ করে গেলে ওঁরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না। শেষে বেয়ারা চা নাস্তা নিয়ে এলে সকলে সেদিকে মনোযোগ দিল। দেখিস, সেই ঘরের ছেলে সেলিম, বুঝে সুঝে পা বাড়াস।