লাইলী মাথা নাড়াল।
আর পেলাম আমার প্রিয়তমার মনের খবর। যা আমার কাছে সারাজীবনের পরম পাওয়া। যা না পেলে আমার জীবন বৃথা হয়ে যেত। আমারটা তো শুনলে, এবার তোমারটা শুনাও।
আমারটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি? তা হলে শুনুন, আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার মত দীনহীনা মেয়ে আপনার অন্তরে বাসা বেঁধেছে। আল্লাহ পাককেই মালুম আমি কতদিন সেই বাসায় বাস করতে পারব।
সেলিম তৎক্ষণাৎ বলল, আমার জীবন যদি সত্য হয়, তবে চিরকালই সেই সত্যের সঙ্গে তুমি আমার অন্তরে বাস করবে।
লাইলী লজ্জা পেয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, এবার চলুন। নচেৎ রিকশাওয়ালা ফিরে যাবে।
যাক না ফিরে ভালইতো। আমি গাড়ি করে তোমাকে পৌঁছে দেব। বিল মিটিয়ে দিয়ে দুজনে গাড়িতে উঠল। সেলিম জিজ্ঞেস করল, ভার্সিটির গেটে রিকশার খোঁজ করবে, না আমার সঙ্গে যাবে?
প্রত্যেক দিন লাইলী ভার্সিটিতে পৌঁছে ফেরার টাইমটা রিকশাওয়ালা করিমকে বলে দেয়। আজ চারটের সময় আসতে বলে দিয়েছিল। সে সাড়ে চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে অন্য প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে। সেলিম ভার্সিটির গেটে গিয়ে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তোমার রিকশা নেই, এই হতভাগা তার প্রিয়তমাকে পৌঁছে দিক?
আপনি হতভাগ্য হতে যাবেন কেন? বরং এই হতভাগীর জন্য এত কষ্ট করবেন? তার চেয়ে আমি একটা রিকশা করে চলে যেতে পারব। আমার মত সাধারণ একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরলে আপনার গার্লফ্রেন্ডরা আপনাকে কিছু বলুক তা আমি চাই না। তা ছাড়া আপনাদের সমাজে ইজ্জৎ আবরুর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু গরীবদের টাকা না থাকলেও তাদের তা আছে।
সেলিম গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তোমার বেশীর ভাগ কথা বড়লোকের প্রতি হুল ফুটান। আর অনেক বোঝাও যায় না।
লাইলী বলল, আগেই তো বলেছি, সত্য বেশির ভাগ সময় অপ্রিয় হয়। আমি স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসি। আমার কথা না বোঝার তো কোনো কারণ নেই। যেমন ধরুন, বড়লোকের ছেলে কোনো গুরুতর অন্যায় করলে, টাকার জোরে তা চেপে দেওয়া হয়। আর কোনো গরিব ছেলে সেই অপরাধ করলে, বিচার করে চাবুক মেরে তার গা থেকে চামড়া তুলে নেয়া হয় বা পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। বড় লোকের মেয়েরা অর্ধনগ্না হয়ে বাইরে গেলে, তাদের ইজ্জৎ যায় না এবং সমাজে তাদেরকে নিয়ে কেউ সমালোচনাও করে না। কিন্তু গরিব লোকের মেয়েরা গেলে তাদের ইজ্জৎও যায় এবং সমাজে তাদের সমালোচনাও হয়। আরও শুনুন আপনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে বা আপনাদের বাড়িতে গেলে কেউ কিছু বলতে সাহস করবে না বা বলবে না। কারণ আপনারা বড়লোক এবং এটা আপনাদের সমাজের রীতি। কিন্তু কেউ যখন আমাদের বাড়ির সামনে আপনার গাড়ি থেকে দু’একদিন আমাকে নামতে দেখবে, তখন বড়লোক, গরীব লোক সকলের কাছে আমি সমালোচনার পাত্রী হয়ে যাব।
সেলিম গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে আমাকে তোমাদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করছ?
নিজের কথার মর্ম যে এটাই বোঝায়, সেলিমের কথা শুনে তা বুঝতে পেরে লাইলী কি বলবে ঠিক করতে পারল না। ভীষণ লজ্জা পেয়ে চুপ করে চিন্তা করল, শেষের কথাগুলো এ সময় বলা উচিত হয় নি।
সেলিম তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, তবু যা হোক একটা কথাতেও তোমাকে হারাতে পারলাম।
লাইলী লজ্জায় কিছু বলতে পারল না।
সেলিমও আর কিছু না বলে তাদের ঘরের গেটের কাছে এসে গাড়ি থামাল। তারপর হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, খুব পিয়াস লেগেছে, একগ্লাস পানি খাওয়াবে?
লাইলী গাড়ি থেকে নেমে বলল, অফকোর্স, আসুন আমার সঙ্গে। আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু অকৃতজ্ঞ নই।
আজ নয় অন্য দিন। তারপর লাইলী কিছু বুঝে উঠবার আগে সেলিম সাঁ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
লাইলী তার গাড়ির দিকে চেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। গাড়িটা বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে কলিং বেলে চাপ দিল।
.
পরের দিন অফ পিরিয়র্ডে কমনরুমে লাইলীর প্রিয় বান্ধবী সুলতানা তাকে জিজ্ঞেস করল, সই, গতকাল শেষের দুটো ক্লাসে তোকে খুঁজে পেলাম না কেন? বাসায় চলে গিয়েছিলি বুঝি?
তুই আগে বল, আমাকে খোঁজ করছিলি কেন?
বা-রে, তোকে আমি আবার কবে খোঁজ করিনি? তবে একটা বিশেষ খবর শোনাব বলে তোকে আরও খোঁজ করছিলাম।
সুলতানার আহ্বা বিরাট বড়লোক। কিন্তু ইসলামের খুব পাবন্দ। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে ঢাকায় দুইটি বাড়ি পেয়েছেন। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, সরকারী বড় অফিসার। গরিবদের প্রতি খুব স্নেহপরায়ন। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই। শুধু চার মেয়ে। সুলতানাই বড়। সেও বোরখা পরে ভার্সিটি আসে। ওদের ফ্যামিলী খুব পদনিশীন। ওর মামাতো ভাই খালেদের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে দুজনের বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে আছে। সে এফ, আর সি, এস, ডিগ্রী নিতে বিলেত গেছে। পাশ করে ফিরে এলেই তাদের বিয়ে হবে। এটা তার শেষ বর্ষ। তারই চিঠি এসেছে। লাইলী ও সুলতানা দুই সই। দুজন দুজনের মনের সব গোপন কথা প্রায়ই বলাবলি করে। হবু স্বামীর চিঠি পেয়ে কিছু কথা বলবে বলে গতকাল সে লাইলীকে খোঁজ করেছিল।
সুলতানার কথা শুনে লাইলী হেসে উঠে বলল, তোর বিশেষ খবর তো খালেদ সাহেবের চিঠি? কই বের কর, তোর জন্য কতটা উতলা হয়ে আছে দেখি।