আমার কি এমন জেনেছ যার ফলে ভয় পেয়েছ। আমাকে দেখে কি অহংকারী ও চরিত্রহীন বলে মনে হয়?
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে লাইলী বলল, তা হলে তো বেঁচে যেতাম। ঐ সব ভেবে মন থেকে আপনার স্মৃতি আস্তাকুড়ে ফেলে দিতাম। আপনাকে ব্যক্তিক্রম দেখে তা পারছি না। যত চেষ্টা করছি ততই আপনি চোরাবালির মত আমার অন্তরে গেড়ে বসে যাচ্ছেন। তার শেষের দিকে কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। তারপর কয়েক সেকেন্ডচুপ করে থেকে আবার বলল, আপনারা বিরাট বড়লোক। আমরা গরিব। আপনার সঙ্গে এভাবে মেলামেশা কি ঠিক হচ্ছে? একটা নগণ্য মেয়ের জন্য আপনি আপনাদের আভিজাত্যে পদাঘাত করতে পারবেন কি? আপনার অভিভাবকরা কি আমাকে মেনে নিতে পারবেন? সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তার চেয়ে এক কাজ করুন, আমার স্বপ্ন আমার অন্তরেই থাক। আপনি দয়া করে আমাকে ভুলে যান। আমি সাধারণ ঘরের মেয়ে। আপনাদের সোসাইটিতে আমার চেয়ে বডলোকের অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। তাদের দিকে একটু নজর দিলে আশা করি আমার কথা আর মনে থাকবে না। আপনাকে না পেলে যে দুঃখ পাব, আমাকে জড়িয়ে আপনার কোনো ক্ষতি হলে তার চেয়ে লক্ষ্যগুণ বেশি পাব। আমি কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে গিয়েও যদি আপনাকে সুখী দেখি, তা হলে আমার জীবন সার্থক মনে করব। আশা করি আমার কাঁদার কারণ বুঝতে পেরেছেন।
সেলিম এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। লাইলীর কান্না দেখে তার চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, হ্যাঁ বুঝেছি। তুমি অকপটে তোমার মনের কথা আমাকে বলতে পেরেছ বলে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ পর্যন্ত আমাদের সোসাইটিতে যত মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তারা শুধু ঐশ্বর্যকে ভালবাসে, আমাকে নয়। আমি তোমার সৎসাহস দেখে শুধু অবাক হয়নি, খুব আনন্দ বোধও করছি। আমার মন বলছে অপাত্রে প্রেম নিবেদন করিনি। তুমি আমাকে যে সমস্ত কারণে ভালবেসে ফেলেছ, আমিও সেইসব কারণে তোমার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। সেখান থেকে আর ফিরতে পারব না। প্রেম ধনী-গরিব বিচার করে না। আমাদের প্রেম যদি সত্যিকার প্রেম হয়, তা হলে ঐশ্বর্যের ব্যবধান আর বংশ মর্যাদা বাধা হতে পারবে না। শোন লাইলী, তুমি আমার স্বপ্ন, আমার মানষী। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। তুমি যদি ইচ্ছা করে সরে যাও, তা হলে আমার জীবনের ঝুঁকি তোমারই উপর বর্তাবে।
লাইলী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু আমি যে সমাজে, যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি সেটা আপনাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি যে কোনো কাজ করি, সেটাকে ধর্মের কষ্টিপাথরে যাচাই করে করি। সে সমস্ত আপনি যদি অপছন্দ করেন, তা হলে আমাদের দাম্পত্ত জীবনে খুব তাড়াতাড়ি ফাটল ধরবে। তখন দুজনেরই জীবন খুব দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।
সেলিম বলল, আমি তো জানি মেয়েদের প্রধান ধর্ম হল, স্বামীকে সব বিষয়ে অনুসরণ করা এবং তার প্রত্যেক কথায় ও কাজে সম্মতি দিয়ে সেই মতো করা।
আপনি ঠিকই জানেন। তবে অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেকটা হল, স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আইনের বাইরে কোনো কাজ করতে বলে, তা হলে সে স্বামীর আদেশ অমান্য করে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আদেশ মানবে। তাতে যদি বিচ্ছেদ ঘটে তবুও। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার উপরও ঐ একই আদেশ। মোট কথা পিতা মাতা হোক আর স্বামী-স্ত্রী হোক, যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) হুকুমের বাইরে আদেশ করলে সেক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) হুকুম অগ্রগণ্য। এমন কি জেহাদের ময়দানে ছেলে পিতা মাতার বিরুদ্ধে এবং স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ছেলে পিতা মাতাকে এবং স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করতে পারে। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে।
সেলিম বলল, তুমি আমার চেয়ে অনেক জ্ঞানী। তোমার সঙ্গে যুক্তিতে পারব। কিন্তু মনে রেখ, যুক্তি দিয়ে তুমি আমার প্রেমের আগুন নেভাতে পারবে না। তুমি আউট বই অনেক পড়েছ। আমিও যদি পড়তাম, তা হলে তোমার যুক্তিকে খণ্ডন করে তোমাকে হারিয়ে দিতাম।
লাইলী বলল, আমি জ্ঞানী না ছাই। জ্ঞানীদের পায়ের ধূলিকণাও নই। তবে আমি অহঙ্কার করছি না, আল্লাহপাকের শোকর গুজার করে বলছি, তিনি আমাকে ইসলামের অনেক বই পড়ার তওফিক এনায়েৎ করেছেন। আমাকে হারাতে হলে আপনাকে আউট বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের বইও পড়তে হবে বলে লাইলী মৃদু হাসল।
তাই পড়ব বলে সেলিম তার দিকে চেয়ে রইল। লাইলীর মৃদু হাসি তার অন্তরকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, সত্যি, আল্লাহ তোমাকে এত সুন্দরী করে সৃষ্টি করেছেন যে, যতই দেখছি ততই দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেখার পিয়াস আর মিটছে না।
লাইলী নিজের প্রশংসা শুনে ভীষণ লজ্জা পেল। বলল, দেখুন, কটা বেজেছে খেয়াল আছে?
সেলিম বেয়ারাকে ডেকে দুটো কো-কের অর্ডার দিয়ে বলল, আর কিছু খাবে?
না বলে লাইলী চুপ করে রইল।
বেয়ারা কোক দিয়ে ফিরে গেলে সেলিম বলিল, ক্লাস কামাই করে দিলাম,
আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে, না?
লাইলী মৃদু হেসে বলল, আপনারও তো ক্লাস কামাই হল, তার জন্য আমার উপর রাগ হচ্ছে না?
সেলিমও মৃদু হেসে বলল, এটা বুঝি আমার উত্তর হল? তোমার উপর রাগ হবে কেন? বরং তোমার কাছ থেকে অনেক জ্ঞান তো পেলামই আর কি পেলাম জান?