লাইলী অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালে চোখ মুছে সেলিমকে ঐ অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে জোড় করা হাত ধরে বলল, ছি ছি, আপনি একি করছেন? উঠুন। সেলিম চেয়ায়ে বসার পর লাইলী আবার বলল, আপনি কোনো অন্যায় করেন নি, করেছি আমি।
সেলিম বলল, আমার তো মনে হচ্ছে আমরা কেউ-ই করিনি। ঠিক আছে, আগে নাস্তা খেয়ে নিই আসুন, তারপর বিচার করব, কে অন্যায় করেছে।
নাস্তা খাওয়ার পর লাইলী বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করুন।
ঐ দিন আমাকে আপনাদের গাড়িতে কে এনেছিল?
প্রথমে মা আপনাকে নিয়ে আসার জন্য গিয়ে দেখে আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তখন আমি দু’হাতে তুলে আপনাকে নিয়ে আসি।
লাইলী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমি আর একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
আপনি অত সংকোচ করছেন কেন? যতকিছু জিজ্ঞেস করুন না কেন, উত্তর দিতে আমি দ্বিধা বোধ করব না। আমি সবকিছু খোলাখুলি পছন্দ করি। কারুর মতো মনে এক আর বাইরে এক, এটা আউট অফ মাই প্রিন্সিপাল।
আপনারা তো খুব বড় লোক?
সেলিম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
আমি যতদূর জানি, যারা খুব বড়লোক, তারা ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলে। আপনাদের বেলায়ও কি কথাটা প্রযোজ্য
দেখুন, ধর্ম কি জিনিস জানি না। তবে মানব ধর্ম আমি মেনে চলি। যা কিছু ন্যায় তাকে ধর্ম জ্ঞান করি। আর যা কিছু অন্যায় তাকে অধর্ম মনে করি।
আপনি ঠিক বলেছেন। তবে কি জানেন, মানুষ নিজের জ্ঞানের দ্বারা ন্যায় অন্যায় বিচার করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল করে ফেলে। ফলে একটা জিনিস তার কাছে ন্যায় হলেও অন্যের কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। কথায় বলে, যত মত তত পথ। তাই আমাদের তথা বিশ্বের সমস্ত মানুষের উচিত, সারা মখলুকাতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তাঁর আইন কানুন মেনে চলা। কারণ একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন তার সৃষ্টিজীবের জন্য কি কি আইন কানুন দরকার হতে পারে। সেই জন্য তিনি কোরআন পাকে এবং তার প্রেরিত রাছুল হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর মারফত হাদিসে সব আইন-কানুন বাতলে দিয়েছেন। সারা বিশ্ববাসী যদি কোরআন ও হাদিস মোতাবেক রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে মেনে চলত, তা হলে পৃথিবীতে এত অশান্তির বহ্নিশিখা জ্বলে উঠত না। আর কোটি কোটি টাকা খরচ করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করে মানুষ মারার ষড়যন্ত্র করত না। ক্লাস এইটের ইংরেজী বই-এ পড়েছিলাম, “ম্যান ইজ দি ওয়ারস এনিমি অফ ম্যান”। মানুষই মানুষের সব থেকে বড় শত্রু। আপনার নাম যখন মুসলমান তখন নিশ্চয় আপনি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আপনি আমার থেকে বেশি জ্ঞানী। তবু আপনাকে অনুরোধ করব, ইসলাম সম্বন্ধে দেশী ও বিদেশী ভাষায় অনেক ধরণের বই আছে সেগুলো পড়তে। তা হলে নিজের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতি জানতে পারবেন। আজকাল স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়ে এবং অনেক উচ্চ ডিগ্রীধারী নর-নারী বিভিন্ন দেশের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিকে দেখে শুনে সেগুলোকে ভালো মনে করে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় কি জানেন? তারাই আবার মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কোরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন না করে আল্লাহর আইন-কানুনকে বিদ্রুপ করে। যাই হোক, আমি তো অনেকক্ষণ বক বক করলাম, মনে কিছু করেননি তো?
সেলিম বলল, না বরং আপনার কাছে আমি অনেক নতুন জিনিস জানতে পারলাম।
লাইলী বলল, আপনি ভুল বললেন। আমি নতুন কিছু বলিনি। জানেন নি বলে পুরান কথাগুলো নতুন বলে মনে হয়েছে।
তা না হয় হল। আপনি কাঁদছিলেন কেন বলবেন না?
লাইলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সত্য কথা অনেক সময় অপ্রিয় হয়। উত্তরটা সেই রকম হয়ে যাবে যে?
যতই অপ্রিয় হোক, তুমি-মানে আপনি বলুন।
আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।
তুমিও তা হলে তাই বলবে বল?
দেখুন মেয়েরা সাধারণতঃ ছেলেদের চেয়ে একটু ব্যাকওয়ার্ড হয়। তাই আপনি এ্যাডভান্স হন, আমিও আপনার পিছু নেবার চেষ্টা করব। সেলিমকে চুপ করে থাকতে দেখে লাইলী বলতে শুরু করল, আমি গোড়ার কথায় ফিরে যাচ্ছি। প্রথমে আপনি স্বীকার করেছেন, আপনারা খুব বড়লোক। সে কথা আপনাদের বাড়িতে জ্ঞান হওয়ার পর বুঝতে পারি এবং তখন থেকেই খুব ভয় পেয়েছি।
সেলিম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ভয় পেলে কেন?
লাইলী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আজ থাক আর একদিন বলব। এখন ক্লাশে যেতে হবে চলুন।
রীষ্টওয়াচের দিকে চেয়ে সেলিম বলল, তুমি আগে আমার দুটি প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর ক্লাশ করার কথা চিন্তা করব। আমার প্রশ্নগুলো তুমি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছ কেন?
লাইলী বলল, আপনার দুটি প্রশ্নের উত্তরে মনের মধ্যে অনেক কথা এসে ভীড় করছে। কিন্তু যখন মনে পড়ছে আপনি বিপদ থেকে বাঁচিয়ে আমাকে তথা নারী জাতিকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছেন তখন আর কোনো কথা বলতে পারছি না। তা ছাড়া কথাগুলো শুনে আপনি আমাকে ভালো মন্দ দুটোই ভাবতে পারেন এবং মনে কষ্টও পাবেন।
তুমি জান না লাইলী, তোমাকে আমি কতটা ভালবেসে ফেলেছি। তোমার কোনো কিছুই আমাকে এতটুকু কষ্ট দেবে না। তুমি নির্ভয়ে বল।
প্রথম কারণ হল, ইসলামের আইন অনুযায়ী যুবক যুবতীদের নির্জনে দেখা করা হারাম। দ্বিতীয় কারণ হল সেই প্রথম ঘটনার দিন থেকে আমিও আপনাকে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছি। তখন কিন্তু জানতাম না, আপনি বড় লোকের ছেলে। যখন জানতে পারলাম তখন থেকে আপনাকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। কিন্তু সফল হতে পারিনি। সব সময় আপনার কথা মনে পড়ে। সামনে পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, সেকথাও ভুলে যাই। বড় লোকদের আভিজাত্যের অহংকারের ও তাদের ছেলেদের চরিত্রহীনতার কথা বাস্তবে দেখে এবং বই-পত্রে পড়ে তাদেরকে আমি বড় ভয় ও ঘৃণা করি। কিন্তু এমনি ভাগ্যের খেলা যে, হঠাৎ আপনার সাথে কি হতে কি হয়ে গেল। আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে করে আমি ভয় পেয়ে কেঁদেছি।