রহমান সাহেব বললেন, শুনে খুশি হলাম। বেশ তাই এসো। তারপর উনি আর জলিল সাহেব চলে গেলেন।
লাইলী নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে যেতে উদ্যত হলে সেলিম বলল, শুনুন।
লাইলী তার দিকে ঘুরে বলল, এগুলো রেখে এক্ষুণি আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল। দুতিন মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বলল, বলুন কি বলবেন।
আপনার ভাইয়াকে আপনি বলে সম্বোধন করছিলেন কেন? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে? আচ্ছা, উনি আপনার কি রকম ভাই?
লাইলী বলল, আপনার সন্দেহ ঠিক। উনি আমাদের বাড়িতে অনেকদিন থেকে ভাড়া আছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে মিশে গেছি। উনি ও উনার স্ত্রী, আব্বা আম্মাকে নিজের বাবা-মার মতো দেখেন। তাদেরকে খালুজান ও খালাম্মা বলে। ডাকেন। তাই আমি ওঁকে ভাইয়া আর ওঁর স্ত্রীকে ভাবি বলে ডাকি।
সেলিম বলল, সত্যি, এরকম সচরাচর দেখা যায় না। তারপর দুজনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুজন দুজনকে দেখতে লাগল। ফলে বারবার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। এক সময় সেলিম বলল, কথা বলছেন না কেন?
লাইলী লজ্জা পেয়ে আঙ্গুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল, চুপ করে থেকেও তো অনেক কিছু বলা যায়।
তা যায়। তবে তারা হল গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত। কিন্তু আমরা তো মানুষ, কথা বলার জন্য আমাদের মুখ আছে। যাই হোক, আমাকে এখন একটু উঠতে হবে বলে সেলিম দাঁড়িয়ে পড়ল।
এমন সময় সাদেক ছুটে এসে বলল, ফুপু আম্মা, আপনাকে আম্মা ডাকছেন। তারপর সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে আপনিই সেদিন ফুপু আম্মাকে গুন্ডাদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন।
হ্যাঁ বলে সেলিম সাদেকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোমার ফুপু আম্মা কিন্তু আমাকে অনেক দিন আগে হামলা করে ঘায়েল করে রেখেছেন।
সাদেক অবাক হয়ে লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমিও তা হলে মারামারী করতে পার?
সেলিমের কথা শুনে লাইলী চমকে উঠল। তারপর সাদেককে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুমিই বলত বাপি, আমাকে কখন কুস্তি বা মারামারী করতে দেখেছ?
কই নাতো? তারপর সেলিমের দিকে চেয়ে বলল, আপনি তা হলে একথা বললেন কেন?
সেলিম ওর গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, সে তুমি এখন বুঝবে না, বড় হলে বুঝবে। এখন আসি দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সেলিম চলে গেল।
ঠিক আড়াইটায় সেলিম ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে চারটের সময় ঘরে ফিরল।
.
পরের দিন সেলিম লাইব্রেরীতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
দুটো দশ মিনিটে লাইলী এসে দেখল, সেলিম চেয়ারে বসে একটা বই দেখছে। সেখানে আর কেউ নেই। শুধু লাইব্রেরীয়ান এককোণে তার সীটে বসে কি যেন লিখছে। লাইলী সেলিমের সামনে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সেলিম শুধু তার মুখের দিকে একদৃষ্ট চেয়ে রইল। সালামের উত্তর বা কোনো কথা বলল না।
লাইলী তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেও বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিচু করে নিয়ে কম্পিত স্বরে বলল, আমি কাছে এলেই আপনি আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকেন কেন? আমার লজ্জা করে না বুঝি? এই কথা বলার পর ও যখন সে কথা বলল না তখন লাইলী আবার বলল, কী চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন!
এবার সেলিম একটু নড়েচড়ে বসে বলল, কথা বলতে বলছেন? বললে শুনবেন তো?
লাইলী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, শুনবার হলে নিশ্চয় শুনবো।
তা হলে আসুন আমার সঙ্গে বলে সেলিম চেয়ার ছেড়ে এগোল।
লাইলী মনের মধ্যে দ্বন্ধ নিয়ে তার পিছু নিল।
সেলিম একেবারে গাড়ির কাছে এসে ড্রইভিং সীটে বসে পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, উঠে আসুন।
গাড়িতে উঠবে কিনা লাইলী চিন্তা করতে লাগল।
সেলিম বলল, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? উঠে আসুন। তাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে আবার বলল, আমাকে কী আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না?
এরপর লাইলী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে দরজার কাছ ঘেসে বসল।
সেলিম সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, আমি সিগারেট খেলে আপনার অসুবিধা হবে না তো?
লাইলী শুধু মাথা নাড়াল।
সিগারেট ধরিয়ে সেলিম গাড়ি ছেড়ে দিল। একেবারে হোটেল ইন্টারকনের গেটে গাড়ি পার্ক করে নেমে লাইলীর দিকের দরজা খুলে দিয়ে নামতে বলল। নামার পর তাকে নিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে মুখোমুখি বসে বলল, কি খাবেন? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, অন্তত এখানে যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ মুখের নেকাবটা সরিয়ে মুখটা ভোলা রাখুন।
লাইলী কিন্তু একটা কথাও বলল না, আর মুখের নেকাবও সরাল না, মাথা নিচু করে বসে রইল।
বেয়ারা বাইরে সাড়া দিলে সেলিম তাকে ডেকে দই মিষ্টির অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতে উঠে এসে লাইলীর মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে দেখল, তার আপেলের মতো নিটোল গোলাপী গাল বেয়ে অশ্রুবিন্দুগুলো মুক্তার ন্যায় গড়াচ্ছে। ভ্যাবাচাখা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি, মানে আপনি কাঁদছেন?
বেয়ারা আসার শব্দ পেয়ে লাইলী মাথাটা আরও নিচু করে নিল।
সেলিম বেয়ারাকে বলল, আমি না ডাকা পর্যন্ত তোমার আসার দরকার নেই। বেয়ারা নাস্তার প্লেট রেখে ফিরে যেতে, সেলিম তার চিবুক ধরে তুলে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল।
লাইলী চোখ বন্ধ করে মুক্তাবিন্দু ঝরাতে লাগল।
তার শরীরের কাপনি অনুভব করে সেলিম চিবুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, জ্ঞানমতে আমি কোনো অন্যায় করিনি। তবু যদি অজান্তে করে থাকি, তবে মাফ করে দিন। প্রীজ আর চুপ করে থাকবেন না। তারপর হাঁটুগেড়ে বসে হাত জোড় করে বলল, চোখ খুলে দেখুন, আপনার সেলিম হাত জোড় করে আপনার কাছে মাফ চাইছে।