আমি এক্ষুণি যাচ্ছি বলে রহিমা খালি চায়ের কাপ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
.
সেলিম পৌঁনে দশটার সময় লাইলীদের বাড়ির গেটের পাশে গাড়ি পার্ক করে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল।
সাদেক দরজা খুলে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সেদিন সে সেলিমকে অল্পক্ষণের জন্য দেখেছিল, তাই চিনতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কাকে চান? কোথা থেকে এসেছেন?
সেলিম এতটুকু ছেলের উকিলি জেরা শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, আমি লাইলীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি কি বাড়িতে আছেন?
সাদেক বলল, জ্বি আছেন, তবে তার সঙ্গে দেখা হবে না। কারণ ফুপুআম্মা কোনো বেগানা লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। যদি বলেন, তা হলে দাদুকে খবর দিতে পারি। নচেৎ এখন বিদায় হন। একজন মেহমান আসার কথা আছে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি।
সেলিম ছেলেটির বুদ্ধি ও কথাবার্তা শুনে আরো অবাক হয়ে বলল, যদি বলি আমিই সেই মেহমান।
এবার সাদেক অবাক দৃষ্টিতে সেলিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, সন্দেহ হচ্ছে।
কেন সন্দেহ হচ্ছে কেন?
তিনি খুব বড় লোকের ছেলে। গাড়ি করে আসবেন। তার পোশাক পরিচ্ছদ খুব দামী।
সেলিম বড় লোকের ছেলে হয়েও পোশাকের দিকে তেমন তার খেয়াল থাকে না। সে সেদিন সাধারণ পোশাক পরে এসেছে।
লাইলী কলিংবেলের আওয়াজ শুনে হাতের কাজ সেরে বারান্দায় বেরিয়ে সাদেককে সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাড়াতাড়ি নিচে এসে জলিল সাহেবকে বলল, ভাইয়া, সেই ছেলেটা এসেছে।
জলিল সাহেব গিয়ে সাদেকের শেষ কথাগুলো শুনে বললেন, সাদেক কি বেয়াদবি করছ? বাড়িতে মেহমান এলে আগে তাকে ঘরে এনে বসাতে হয়, তারপর আপ্যায়ন শেষে আলাপ করতে হয়।
সাদেক বলল, জান আব্বু, ইনি না ফুপু আম্মাকে খোঁজ করছিলেন। তাই আমি ওনার পরিচয় জেনে নিচ্ছিলাম। তা হলে এনারই আসার কথা ছিল? তারপর সেলিমের একটা হাত ধরে বলল, আমি তো আপনাকে চিনি না, তাই অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি। মাফ করে দিন।
সেলিম এতটুকু ছেলের কথাবার্তা ও ব্যবহারে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে বলল, না, তুমি কোনো অন্যায় করনি। বরং আমি খুব খুশি হয়েছি।
জলিল সাহেব বললেন, ভিতরে চলুন। ওরা সবাই এসে ড্রইংরুমে বসল।
এমন সময় রহমান সাহেব ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বললেন, আপনি আসায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। সেদিন আমার মেয়েকে উদ্ধার করে যে উপকার করছেন, সে কথা আর কি বলব বাবা, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমরা মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। সেই পরম করুণাময়ের নিকট দোয়া করি, তিনি আপনাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল করুন।
সেলিম বলল, আমি এমন কোনো মহৎ কাজ করিনি। আপনার মেয়ে বিপদে পড়েছিলেন, আমি সাধ্যমত তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে সফল হয়েছি। এটা করা প্রত্যেক মানুষের একান্ত কর্তব্য।
জলিল সাহেব উঠে গিয়ে নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখলেন।
রহমান সাহেব বললেন, আপনারা নাস্তা খেয়ে নিন, আমি আসছি। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।
সারা শরীর ও মাথা ঢেকে লাইলী চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন? খালা আম্মা ভালো আছেন?
সেলিম লাইলীর সুমিষ্ট গলার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে সালামের জবাব না দিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, আমাদের সব ভালো। আপনি এই কয়দিন ভার্সিটি যাননি কেন? আমি মনে করেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে আপনার অসুখ করেছে।
লাইলী বলল, শরীর একটু খারাপ হয়েছিল, এখন ভালো আছি। কাল থেকে ভার্সিটি যাব। সে দুটো প্লেটে নাস্তা তৈরি করে জলিল সাহেবকে বলল, ভাইয়া আপনিও আসুন।
নাস্তা শেষে তারা যখন চা খাচ্ছিল তখন রহমান সাহেব এসে চেয়ারে বসলেন।
লাইলী আব্বাকে চা দিল।
চা খেতে খেতে তিনি বললেন, আপনাকে একটা অনুরোধ করবো রাখবেন?
সেলিম বলল, দেখুন, আমি আপনার ছেলের মতো, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? তুমি করেই বলুন।
সেলিমের কথা শুনে তার দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেল। সেটা গোপন করার জন্য কোনো কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।
সেলিম কিছু বুঝতে না পেরে লাইলীর দিকে তাকিয়ে রইল।
জলিল সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, ওঁর একটা ছেলে ছিল। বি. এ. পাশের রেজাল্ট নিয়ে ফেরার সময় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। সেই থেকে কেউ ছেলের মতো ব্যবহার করলে সামলাতে পারেন না। ওঁর ব্যবহারে আপনি কিছু মনে নেবেন না।
লাইলীর চোখেও পানি দেখে সেলিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় রহমান সাহেব ফিরে এসে বসলেন। মুখটা থমথমে।
সেলিম বলল, আমি না জেনে আপনাদের মনে দুঃখ দিলাম। আমাকে মাফ করে দিন।
রহমান সাহেব ধরা গলায় বললেন, না বাবা তুমি কোনো অন্যায় করনি। শুধু শুধু মাফ চাইছ কেন? আমি তখন যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, তুমি যদি দুপুরে একমুঠো ভাত খেয়ে যাও, তা হলে আমরা খুব খুশি হতাম।
সেলিম কারও বাড়িতে কখনো ভাত খায় না। যত বড় বন্ধু-বান্ধবী হোক না কেন, চা থেকে বড় জোর নাস্তা পর্যন্ত। কে মনে কষ্ট করল না করল, তা কোনোদিন ভাবেনি। কিন্তু আজ সে প্রতিবাদ করতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আবার কষ্ট করতে যাবেন কেন? এইতো কত কিছু খেলাম।
জলিল সাহেব বললেন, আপনার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তা হলে আর আপত্তি করবেন না।
সেলিম এক পলক লাইলীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, কত মিনতিভরা দৃষ্টিতে সে তার দিকে চেয়ে আছে। বলল, আমি এখন এক জায়গায় যাব। বেলা দুটোর মধ্যে ফিরে আসব।