মাহবুব বলল, কি কথা?
কাচারী বাড়িতে এসে বস, তারপর বলব।
মাহবুব সরল মনে তার সঙ্গে কাঁচারী বাড়িতে গিয়ে বসে বলল, এবার বল কি বলবে।
তাহেরা একটুখানি বস আসছি বলে ছুটে ভিতর বাড়িতে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে দুতিন পদের মিষ্টি চানাচুর ও এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে বলল, তুমি কলেজ থেকে ফিরছ, এগুলো আগে খেয়ে নাও তারপর বলছি।
মাহবুব ভাবল, ওর কোনো ভাইয়ার হয়ত বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। মৃদু হেসে বলল, কি ব্যাপার? কোনো শুভ সংবাদ না কি?
তাহেরা সলাজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যা ভাবছ তা নয়; তবে বলে থেমে গেল।
কি হল থেমে গেলে কেন? তবে কি বলবে তো।
বলছি এগুলো আগে খেয়ে নাও।
মাহবুব প্রথমে সরবত খেল। তারপর দুটো মিষ্টি খেয়ে বলল, নাও এবার বল।
মাহবুব ভাই, একটা কথা তোমাকে জানাব বলে অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছি, কিন্তু তোমাকে একাকি না পেয়ে বলতে পারিনি। অবশ্য চিঠি দিয়েও জানাতে পারতাম; কিন্তু সাহস হয়নি।
মাহবুব তাহেরার মনের কথা বুঝতে না পেরে বলল, বেশতো এখন বল।
তাহেরা লজ্জায় সরাসরি কথাটা বলতে না পেরে বলল, কি বলব, তুমি কী বুঝতে পারছ না?
মাহবুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বলবে, আমি কিভাবে বুঝব?
তাহেরা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে ভালবাসি। কথা শেষ করে আবার মাথা নিচু করে নিল।
তরুণ মাহবুব ভালবাসা কি জিনিস জানে না। মেয়েদের নিয়েও কখনো চিন্তা করেনি। তাহেরার কথা শুনে অবাক হল। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাহেরা মোটামুটি সুন্দরী। গায়ের রং শ্যামলা, স্বাস্থ্য দোহারা, লম্বায় পাঁচ ফুট, চোখ দুটো বেশ বড় বড়। নাকটা খাড়াও নয় ধ্যাবড়াও নয় মধ্যম। মাথার চুল যে খুব লম্বা, তা খোঁপা দেখেই বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর তাহেরা মাথা তুলে মাহবুবের দিকে তাকাতে গেলে চোখে চোখ পড়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল, কিছু বলছ না কেন মাহবুব ভাই?
অজান্তেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাহবুব বলল, ভালবাসা কি জিনিস আমি জানি না। তবে শুনেছি ভালবাসা মনের ব্যাপার। আমার মনে সেরকম কিছু এখনো হয়নি। তা ছাড়া মেয়েদের নিয়ে আমি কখনো চিন্তা করিনি। আরো শুনেছি ভালো লাগা থেকে ভালবাসা জন্মায়। আমাকে তোমার হয়তো ভালো লেগেছে। তাই তোমার মনে ভালবাসা জন্মেছে।
আমাকে তোমার ভালো লাগেনি?
তোমাকে আমি গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের নজরে দেখি। যখন ভালো লাগবে এবং মনে ভালোবাসা জন্মাবে তখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। এখন চলি বলে মাহবুব চলে এসেছিল। তারপর আর কোনো দিন তাহেরার সামনে যায়নি। এমন কি তাহেরা তাদের চাকরের হাতে অনেকবার ডেকে পাঠালেও যায়নি।
মাহবুব এইচ. এস. সি.তে পাঁচটা লেটার নিয়ে পাস করার পর যখন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে চাইল তখন কোনো উপায় না পেয়ে সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাউলাত নিয়েছিলেন। তারপর মাসে মাসে যখন মাহবুবকে টাকা পাঠাবার দরকার হল তখনও তার কাছে আবার যান।
আলাউদ্দিন মীর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছেন ভালো কথা; কিন্তু তার পড়াশোনা শেষ করতে যেমন অনেক সময় লাগবে তেমনি অনেক টাকা পয়সাও লাগবে। এত টাকা আপনি পাবেন কোথায়? আর আমিও শুধু শুধু আপনাকে এত টাকা হাউলাত দেব কেন? তা ছাড়া টাকাটা কিভাবে ফেরৎ দেবেন তা ভেবেছেন কি?
সুলতান খাঁন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আমিও যে এ ব্যাপারে কিছু চিন্তা করিনি তা নয়। ভেবেছি, বাস্তু সংলগ্ন যে জমিটা আছে সেটা আপনার কাছে পাঁচ বছরের জন্য বন্ধক রাখব।
আলাউদ্দিন মীর বললেন, জমি রাখলে আপনাদের সংসার চলবে কি করে? তার চেয়ে এক কাজ করুন, পুকুরটা পাঁচ বছর নয় সাত বছরের জন্য সাফকবলা রাখুন। এক লাখ টাকার দলিল হবে। টাকাটা একসঙ্গে নেন আর দফায় দফায় নেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। অবশ্য পুকুরের আসল দাম দুতিন লাখ টাকা। বেশি নিলে পুকুর ফেরাবেন কি করে? তাই এক লাখের কথা বললাম। সাত বছরের মধ্যে যখনই টাকা ফেরৎ দেবেন তখনই দলিল ফেরৎ দিয়ে দেব। পুকুর আপনার দখলেই থাকবে। তবে সাত বছরের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে দলিল মোতাবেক পুকুরের স্বত্ব আমার হয়ে যাবে।
সুলতান খাঁন বললেন, আজ কিছু টাকা দেন, মাহবুবকে পাঠাতে হবে। চিন্তা ভাবনা করে কয়েক দিন পরে কাগজ পত্র নিয়ে আসব।
সেদিন রাতে সুলতান খাঁন স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথা জানালেন।
মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আল্লাহর মহিমা তিনিই জানেন। আপনার মতই আমার মত। তবে আমার মনে হয় মাহবুবের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
সে কথা আমিও ভেবেছি; কিন্তু জানালে সে যদি পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়? কিভাবে পড়াচ্ছি তাও তো জানে না। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ওঁর পড়াশোনা শেষ হবে। তারপর চাকরী করে দুতিন বছরের মধ্যে নিশ্চয় টাকাটা ফেরৎ দিতে পারবে। তারপর বললেন, আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছেন, তা হবেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে আমরা আর কি করব?
মরিয়ম খাতুন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আপনি যা ভালো বুঝেন করেন।