এই পুকুরটা খুব বড়। লম্বায় দুশ হাত, আর চওড়ায় একশো হাত। এটা সূলতান খানের দাদা বাদশা খান কাটিয়েছিলেন। আশ-পাশের পাঁচ-দশ গ্রামের মধ্যে খুব ধামিক ও দানশীল হিসাবে তার খুব সুনাম ছিল। দেখতেও খুব সুপুরুষ ছিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, মুখভরা চাপদাড়ি নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন দরবেশের মতো মনে হত। অবাল বৃদ্ধ বনিতা সালাম দিয়ে পথ ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তিনি সালামের উত্তর দিতে দিতে প্রত্যেকের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন। নিঃস্ব ও গরিবদের প্রকাশ্যে ও গোপনে অকাতরে দান করতেন। কয়েকবার হজ্ব করেছেন। একশো বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করত না, এত বয়স হয়েছে। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হত একজন বলিষ্ঠ যুবক যাচ্ছেন। এই বয়সেও দেড়মনি ধানের বস্তা একা মাথায় তুলে নিতে পারতেন। সামান্য কয়েক দিনের জ্বরে মারা যান। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। গ্রামের লোকজন গ্রীষ্মকালে পানির খুব কষ্ট পেত। তাই বেশ কিছু জমি বিক্রি করে এই পুকুর কাটান এবং পাড়ের চার দিকে চারটে পাকা ঘাট করেছেন। ফলে আর্থিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। তাতে তিনি কখনো দুঃখ অনুভব করেন নি। বরং যখন সমবয়সিরা বলতেন, বাদশা খান, এই পুকুর কাটাতে গিয়ে তুমি অভাব গ্রস্থ হয়ে পড়লে, কাজটা ঠিক করনি। এসব জমিদারের কাজ। তখন তিনি মৃদু হেসে বলতেন, কেন আমি একাজ করলাম তা যদি জানতে, তা। হলে এ কথা বলতে পারতে না। তোমরা তো জান না, মানুষের উপকারের জন্য কিছু করলে আল্লাহ খুশি হন। হাদিসে আছে আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালবাসতে হবে।
পুকুরের চার দিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাদশা খান প্রতি বছর যখন পুকুরের মাছ ধরে বিক্রি করতেন তখন গ্রামের ধনী গরিব সকলের বাড়িতে মাছের ভেট পাঠাতেন। আর প্রতি মৌসুমে বাগানের ফল মূলও সবাইকে দিতেন। ছেলে রুস্তম খানও তাই করতেন। সুলতান খাঁনও বাপ দাদার প্রথা চালু রেখেছেন। বাদশা খানের লাঠি খেলার ভীষন সখ ছিল। প্রতি বছর বসন্তকালে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিয়ালদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়ে লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন। যিনি বিজয়ী হতেন, তাকে বেশ মোটা টাকা পুরস্কার দিতেন। তিনি নিজেও খুব ভালো লাঠিয়াল ছিলেন। তার আর একটা সখ ছিল সাঁতার কাটা। প্রতি বছর লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার পর সাঁতারের প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিজেও দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। ছেলে রুস্তম খানকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছিলেন। রুস্তম খানের একমাত্র ছেলে সুলতান খাঁন, তিনি সুলতান খাঁনকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছেন।
সুলতান খাঁন দাদা বাদশা খানের মত সুপুরুষ। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অধীকারি, গায়ের রংও দাদার মতো। গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে দ্বিতীয় বাদশা খান বলে ডাকেন। সুলতান খাঁনের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়, নাম মাহফুজা। মাহফুজার ছয় বছরের ছোট মাহবুব। সুলতান খাঁনও ছেলে মেয়েকে লাঠিখেলা ও সাঁতার শিখিয়েছেন, মাহবুব ছোটবেলা থেকে দক্ষ সাঁতারু। একটু দুরন্ত ধরনের ছেলে। ছোট বেলা থেকেই এত বড় পুকুর একা একা সাঁতার কেটে এপার ওপার করত। সুলতান খাঁন যখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটতেন তখন পাড়ার অবাল বৃদ্ধ বণিতা চার পাশে পাড় থেকে দেখত। মাহবুব ছিল পানির পোকা। ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটত। তার বয়স যখন পনের তখন থেকে সুলতান খাঁন ছেলের সঙ্গে সাঁতারে পাল্লা দিতে পারতেন না। ঢাকার ভার্সিটিতে পড়তে এসে প্রতিবছর সাঁতার প্রতিযোগীতায় ফাষ্ট হয়। সেই সাথে স্যুটিং ও কুংফুতে পারদর্শী হয়েছে। ছাত্র হিসাবেও খুব ভালো। তাই সুলতান খাঁন। তাকে উচ্চ ডিগ্রী নিতে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। মেয়ে মাহফুজা ও ভালো ছাত্রী। এস.এস. সি, পান করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ বাড়ী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। সাত আট মাইল দূরের গ্রামের একটা ভালো ছেলের সন্ধান পেয়ে সুলতান খাঁন তার বিয়ে দিয়ে দেন। তিনিও ছিলেন দাদার মতো দানি। তাই কোনো সঞ্চয় না থাকায় মেয়ের বিয়ের সময় কিছু জমি বিক্রি করেন। বংশ পরম্পরায় ফসলী জমি বারবার বিক্রি হওয়ায় সুলতান খাঁনের আগের মতো স্বচ্ছলতা নেই।
এই গ্রামের মীরেদের অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। তারা এক সময় বাদশা খানের প্রজা ছিল। সেই বংশের আলাউদ্দিন মীরের অবস্থা এখন খুব ভালো। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা সবার ছোট। নাম তাহেরা। আলাউদ্দিন মীরের পাঁচ ছেলের তিন ছেলে বিদেশে চাকুরী করে। তিনিই এখন গ্রামের সেরা ধনী। সুলতান খাঁনের জমি তিনিই কিনেছেন। তার পুকুরটার দিকে আলাউদ্দিন মীরের অনেক দিনের লোভ। খানেদের অবস্থার অবনতি দেখে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
একই গ্রামের ছেলে মেয়ে হিসাবে মাহবুব ও তাহেরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকে চিনত। বড় হওয়ার পর তাহেরা মাহবুবকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সে কথা তাকে জানাতে পারেনি। মাহবুব যখন ইন্টারে তখন তাহেরা নাইনে পড়ে।
এক গ্রীষ্মের অপরাহ্নে চারিদিক রোদে খাঁ খাঁ করছে। চারিদিক নিস্তব্দ। লোক জন রাস্তা ঘাটে নেই। যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। লিচু গাছের তলায় একটা দুধেল গাই শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। তার সাত দিনের বাচ্চাটা একবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছে, আবার ছুটে মায়ের কাছে ফিরে আসছে। একটা ঘুঘু পাখি শিরিশ গাছের উঁচু ডালে বসে অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। একটা কাঠ ঠোকরা বড় আম গাছের গুঁড়িতে বসে ঠোঁট দিয়ে গাছের গুঁড়িতে ঠক ঠক করে ঠোকর দিচ্ছে। তাহেরা তাদের কাঁচারী বাড়ির জানালার ধারে বসে এই সব দেখছে। আর একবার করে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। সময় পেলে প্রায় প্রতিদিনই সে এখানে বসে ভাবে, মাহবুবকে একা যেতে দেখলে ডেকে মনের কথা জানাবে। কিন্তু সব দিনই কেউ না কেউ তার সঙ্গে থাকে। মাহবুব তাদের কাঁচারী বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজে যাতায়াত করে। আজ তাকে একা দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়াল। কাছে এলে বলল, মাহবুব ভাই তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।