বিকেলে চায়ের টেবিলে মাহবুবা মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাহবুবকে দেখে তোমাদের কেমন মনে হল। তারপর বলল, জান বাবা, উনি শুধু ভালো সাঁতারু নন, একজন দক্ষ সুটার ও ফাইটারও।
শামীমা বেগমের মাহবুবকে দেখে ভীষন পছন্দ হয়েছিল? কিন্তু সে গ্রামের এক সাধারন ঘরের ছেলে জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই স্বামী কি বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করুতে লাগলেন।
আনিস সাহেব গালিবের কথা ভাবছিলেন, কিভাবে তার কথা ওঠাবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
মা-বাবা কিছু বলছে না দেখে মাহবুবা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন? মেয়ের কথা শুনে আনিস সাহেব বললেন, ছেলেটার সব কিছু ভালো, তবে খুব আদর্শবান। ধার্মিক বলেও মনে হল। দেখলি না, কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেয়। এই। ধরনের ছেলেরা জীবনে উন্নতি করতে পারে না।
স্বামী থেমে যেতে শামীমা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে এক মত। তা ছাড়া ও গ্রামের একটা সাধারন ঘরের ছেলে। আমাদের জামাই হওয়ার মোটেই উপযুক্ত নয়।
আনিস সাহেব বললেন, ওর থেকে আমাদের ম্যানেজারের ছেলে গালিব অনেক ভালো।
শামীমা বেগম বললেন, গালিবের সব কিছু ভালো হলেও তার চোখ আমার একদম পছন্দ নয়। শরীরের তুলনায় চোখ দুটো খুব ছোট। এরকম হাতি চোখা ছেলেকে আমি একদম পছন্দ করি না।
মাহবুবা বলল, আমি তোমাদের কথা অস্বীকার করছি না। তোমাদের মতের বিরুদ্ধেও কিছু করব না, তবে মাহবুবকে যদি আমাদের ফ্যামীলির উপযুক্ত করে নিতে পারি, তা হলে?
আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।
মাহবুবা বলল, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। আমি মাহবুবকে তোমাদের উপযুক্ত করে নেবই। আমি যা বলি তা যে করেই থাকি, তা তো তোমরা জানই।
২. আষাড়ের শেষ
০২.
বেলা প্রায় একটা। তখন আষাড়ের শেষ। সুলতান খাঁন ছাতা মাথায় দিয়ে জমির আলের উপর বসে আছেন। দশ বার জন কামলা জমিতে আমন ধানের চারা বপন করছে। হাত ঘড়ি দেখে কামলাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার কাজ রেখে দিন। একটু পরে আজান হবে। বাড়ি গিয়ে নামাজ ও খাওয়া দাওয়ার পর এসে কাজ করবেন। কথা শেষ করে তিনি বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন।
সুলতান খাঁনের যারা কাজ করে, তারা জানে তিনি সব সময় তাদের কাজের। তদারকি করলেও নামাযের সময় হলে সবাইকে নামায পড়তে বলে নিজেও পড়বেন। যদি জানতে পারেন কামলাদের মধ্যে কেউ বেনামাযী আছে, তা হলে তাকে নামায না পড়লে কি হয় এবং পড়লে কি হয় প্রথমে বোঝাবেন। তারপরও যদি সে না পড়ে তা। হলে কাজ থেকে ছাটাই করবেন। এই ভাবে তিনি অনেক অশিক্ষিত কামলাদের নামায ধরিয়েছেন।
সুলতান খাঁন বাড়িতে ঢুকে জমিরনকে দেখে বললেন, তোর চাচি কোথায় রে মা?
জমিরন এই গ্রামেরই মেয়ে। তার স্বামী জব্বার খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। তাদের একটাই মেয়ে। পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে জব্বার জন্ডিসে মারা গেছে। জব্বার সুলতান খাঁনের কাছে বার মাস কামলা খাটত। স্বামী মারা যাওয়ার পর জমিরন যখন সুলতান খাঁনের পা জড়িয়ে বলল, চাচা, আমার যে কেউ রইল না, আমি কেমন করে দিন গুজরান করব। তখন সুলতান খাঁন বললেন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত জীবকে আহার দিয়ে থাকেন। এটা কোরআন পাকের কথা। আজ থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। সেই থেকে জমিরন এ বাড়িতে রয়েছে।
চাচার কথা শুনে জমিরন বলল, চাচি রান্না করছে, আমি ডেকে দিচ্ছি।
মরিয়ম খাতুন প্রাইমারী পাশ মেয়ে হলেও স্বামীর সহচার্যে অনেক শিক্ষা পেয়েছেন। স্বামীর সাহায্যে মুসলিম মনিষি ও মনিষাদের জীবনী ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়ে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ গৃহিনী ও আদর্শ মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাই স্বামীর কখন কি প্রয়োজন সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। প্রতিদিনের মতো আজও যোহরের আযান শুনে হাত পাখা, সর্ষের তেলের বাটি, লুঙ্গি ও গামছা হাতের কাছে। রেখে রান্না করছিলেন। স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় জমিরনকে দেখে বললেন, তরকারীটা হতে একটু বাকি, নুন চেখে নামিয়ে নিস। তারপর স্বামীর কাছে এসে সালাম দিলেন।
সুলতান খাঁন ততক্ষণে বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে কোনোদিন আগে সালাম দিতে পারলাম না। আগন্তুক আগে সালাম দিবে এটাই ইসলামের নিয়ম।
মরিয়ম খাতুন মৃদু হেসে বললেন, তা আমিও জানি। আরো জানি, যে আগে সালাম দিবে, তার সওয়াব উত্তর দাতার চেয়ে নব্বইগুন বেশি। তারপর হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললেন, ঐ দিন কোরআনের তফসীর পড়ার সময় দেখলাম
আল্লাহ পাক বলিয়াছে, তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে অগ্রসর হও।
সুবহান আল্লাহ বলে সুলতান খাঁন বললেন, তুমি এত বখীল যে, প্রায়ই সে সওয়াব থেকে আমাকে বঞ্চিত কর।
মরিয়ম খাতুন বললেন, হাদিসে পড়েছি, সওয়াব হাসিলের জন্য কোনো কাজে অগ্রভূমিকা নিলে বখীলতা হয় না। এখন ওসব কথা থাক, গোসল করে আসুন। আজান হয়ে গেছে। আপনার তো আবার কিছুক্ষন সাঁতার না কাটলে গোসলই হয় না। কথা শেষ করে তেলের বাটিটা সামনে ধরলেন।
সূলতান খান ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল তেলের বাটিতে ডুবিয়ে প্রথমে নাকে, কানে ও নাভিতে দিলেন। তারপর হাতের চেটোতে তেল ঢেলে মাথার চাঁদিতে ঘষতে ঘষতে অন্য হাতে লুঙ্গি ও গামছা নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলেন।