মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা সে কথা বলেছেন। ওঁনার মতো মহিলা কখনো দেখা তো দূরের কথা, কোনো বই-পুস্তকেও পড়িনি।
সুলতান খাঁন বললেন, মুসলিম মনিষাদের জীবনী পড়ো, তা হলে তোমার চাচির থেকে আরো ভালো মহিলাদের কথা জানতে পারবে।
আচ্ছা চাচা, মাহবুব কি কলেজে পড়ার আগে মাদ্রাসায় পড়েছে?
ছোটবেলায় মক্তবে কোরআন ও নামায পড়া শিখেছে। তারপর মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে হাই স্কুলে ভর্তি করে দিই। তবে ঘরে প্রচুর ধর্মীয় বই পড়েছে। আর এর পিছনে তোমার চাচির অবদান শতকরা নব্বই ভাগ। জেনে রেখ মা, একমাত্র মা-ই পারে ছেলেমেয়েকে সব বিষয়ে আদর্শবান করে গড়তে। তাই তো মাকে সব। বিষয়ে আদর্শবর্তী হতে হয়।
আপনি অতি মূল্যবান কথা বলেছেন। এখানে না এলে আমি এসব জানতে পারতাম না।
এমন সময় মরিয়ম খাতুন এসে হাত পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে করতে বললেন, মেয়ের সঙ্গে কী এত কথা হচ্ছে?
সুলতান খাঁন বললেন, মাহবুবাকে আমরা মেয়ে হিসাবে পাব, এত বড় সৌভাগ্য। কী আমাদের কপালে আল্লাহ রেখেছেন?
মরিয়ম খাতুন বললেন, সে কথা আল্লাহপাক জানেন। কপালে রাখলে নিশ্চয় পাব। তারপর বললেন, আমি চারের মসলা ভেজে রেখেছি। বেলা হয়েছে, মাছ ধরার কথা বলেছিলেন না?
সুলতান খাঁন ঘড়ি দেখে বললেন, ঘন্টাখানেক পরে যাব। কামলাদের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন।
ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে গোসল করতে যাওয়ার সময় সুলতান খাঁন ড্রাইভার ও মাহবুবাকে পুকুর দেখাতে নিয়ে এলেন। মাছ ধরার জন্য কাঁধে করে খেয়া জালও নিয়ে এলেন।
পুকুর দেখে মাহবুবা বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। একবার নবাব বাড়ি দেখতে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দেখেছিল। বেড়াতে গিয়ে রমনা পার্কের লেকও কলাবাগানের লেক দেখেছে; কিন্তু এতবড় পুকুর কখনো দেখেনি। চারদিকের পাড়ে নানা রকম ফলের গাছ পালা দেখে মুগ্ধ হল। চারটে ঘাটেই মেয়ে পুরুষ গোসল করছে, অনেকে কাপড় কাঁচছে।
সুলতান খাঁন বাজার থেকে কয়েক পদের সুগন্ধি মসলা কিনে এনেছিলেন। সেগুলো কুড়া ও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরে তিন জায়গায় ফেলে মাহবুবাকে বললেন, চল মা, তোমাকে বাগানের গাছপালা দেখাই। তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও চলুন।
যেতে যেতে মাহবুবা বলল, আপনি পুকুরে দুতিন জায়গায় কি যেন ফেললেন।
সুলতান খাঁন বললেন, এতবড় পুকুরে খেয়াজালে মাছধরা খুব শক্ত। তাই সুগন্ধী মসলা দিয়ে মাছের খাবার তৈরি করে ফেললাম। সুগন্ধ পেয়ে মাছ যখন খেতে আসবে তখন জাল ফেলব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবে ফিরে যেতে চাও?
মাহবুবা বলল, পরশু দিন।
তা হলে কাল ছিপ ফেলব। আল্লাহ রাজি থাকলে যদি বড় মাছ ধরতে পারি, তা হলে তোমার মা-বাবার জন্য নিয়ে যাবে।
না চাচা, এত দূর থেকে মাছ নিয়ে যাওয়ার কী দরকার? ঢাকাতেই কত বড় মাছ পাওয়া যায়।
তা যাবে না কেন? কিন্তু সে সব নদীর মাছ। পুকুরের মাছের স্বাদই আলাদা। তারপর বললেন, তোমরা ঘুরে দেখ আমি যাই। বেশি দেরি করলে মাছ খাবার খেয়ে চলে যাবে।
মাহবুবা জাল ফেলে মাছ ধরা কখনো দেখেনি। বলল, অন্য সময় বাগানের গাছ। পালা দেখতে আসব, এখন আপনার মাছ ধরা দেখব।
সুলতান খাঁন প্রথমে যে জায়গায় মাছের খাবার ফেলেছিলেন, সেখানে জাল ফেললেন। কিন্তু মাছ পড়ল না। তারপর দ্বিতীয় জায়গায় ফেলতে একটা চার পাঁচ কেজি কাতলা মাছ পড়ল।
মাছ দেখে মাহবুবা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, এর থেকেও বড় মাছ আছে?
সুলতান খাঁন হাসিমুখে বললেন হ্যাঁ মা আছে। প্রতি বছর একবার বেড়াজাল দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। সে সময় ধরা পড়ে। তার মধ্যে দশ থেকে বিশ ত্রিশ কেজি ওজনেরও মাছ থাকে।
মাহবুবা অবাক হয়ে বলল, এতবড় মাছও আছে?
হা-মা, ওর থেকেও বড় মাছ আছে। গতবারে পঞ্চাশ কেজি ওজনের একটা ভেটকী মাছ পড়েছিল।
মাহবুবা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ওমা, তাই নাকি? অতবড় মাছ আমি। কখনো দেখিনি।
সুলতান খাঁন বললেন, তুমি চৈত্র মাসে মাহবুবের সঙ্গে এস, ঐ সময় মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। বড় বড় মাছ দেখতে পাবে। তারপর বললেন, তুমি ঘাটে গাছের ছায়ায় বস, আমি গোসল করে নিই। মাছসহ জালটা ঘাটের উপর রেখে সুলতান খাঁন পুকুরে নেমে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে উঠে এসে বললেন, চল মা, এবার ফেরা যাক। ততক্ষণে ড্রাইভার সেখানে এসেছে।
পুকুরের বিশালতা ও পানি দেখে মাহবুবা প্রথমে ভয় পেয়েছিল। সুলতান খাঁন সাঁতার কাটতে কাটতে যখন পুকুরের মাঝখানে গেলেন তখন আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। ফেরার সময় জিজ্ঞেস করল, সাঁতার কাটার সময় আপনার ভয় লাগেনি?
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, ভয় লাগবে কেন? তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?
জ্বি জানি। স্টেডিয়ামের সুইমং পুলে সাঁতার কাটি।
তা হলে ভয়ের কথা বলছ কেন?
সুইমং পুল তো এত বড় না। তা ছাড়া তাতে কোনো বড় মাছ নেই। আচ্ছা চাচা, এই পুকুরে কুমীরওতো থাকতে পারে?
নদীতে বা সাগরে যে সব বড় বড় কুমীর থাকে সে সব নেই। তবে ছোট খাট মেছোকুমীর থাকতে পারে?
মেছো কুমীর কী চাচা? তারা কী মানুষকে মেরে ফেলে?
না মা, তারা শুধু মাছ খায়। তাই তাদেরকে মেছো কুমির বলে।