সুলতান খাঁন বাজারে চলে যাওয়ার পর মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে বলল, চাচা ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রাম দেখতে যাওয়ার কথা বললেন, যাব চাচি আম্মা?
মরিয়ম খাতুন বললেন, বিকেলে যেও। এখন তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ করব।
ঠিক আছে, তাই যাব।
মরিয়ম খাতুন জমিরনকে ডেকে বললেন, চাল বেছে চুলো জ্বালা। তোর চাচা বাজার থেকে ফিরলে আমি তরকারী রান্না করব।
জমিরন চলে যাওয়ার পর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যখন আমাদের মেয়ে হতে চাও তখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো মা?
মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা কি যে বলেন, আপনার কথায় কিছু মনে করব কেন? আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।
মরিয়ম খাতুন বললেন, আমাদের বংশের একটা আলাদা সুনাম আছে। এই বংশের মেয়েরা বেপর্দায় বাইরে চলাফেরা করে না। আর বেপর্দায় চলতে আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) নিষেধ করেছেন। তিনি তাঁর পেয়ারা হাবীবকে উদ্দেশ্য করে কোরআনে বলিয়াছেন, হে নবী (দঃ) আপনার স্ত্রীগণকে ও আপনার কন্যাগণকে এবং অন্যান্য মুমেনদের নারীদিগকেও বলিয়া দিন যে, তাহারা যেন স্ব-স্ব চাদরগুলি নিজেদের (মুখমণ্ডলের) উপর (মাথা হইতে) নিম্নদিকে একটু ঝুলাইয়া লয়; ইহাতে শীঘ্রই তাহারা পরিচিত হইবে, ফলতঃ তাহারা নির্যাতিত হইবে না; এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
মেয়েরা যদি আল্লাহর হুকুম মতো পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করত, তা হলে রাস্তা-ঘাটে এত নির্যাতীত হত না। তুমি শহরের মেয়ে সেখানকার পোশাক-আশাক, চাল-চলন আলাদা। তুমি গ্রাম দেখবে তাতে কোনো বাধা নেই। তবে যাওযার সময় তোমাকে। বোরখা পরে অথবা বড় চাদর গায়ে দিয়ে যেতে হবে। শোন মা, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে অন্যায় ও অশালীন ছাড়া সবকিছু করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি কোরআনে বলিয়াছেন, হে বনী আদম, প্রত্যেকবার মসজিদে উপস্থিত হওয়ার কালে নিজেদের পোশাক পরিদান করিয়া লইও এবং খুব খাও ও পান কর। আর সীমার বাইরে যাইও না। নিশ্চয় আল্লাহতালা সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না।
হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, আহার কর, পান কর, দান কর এবং পরিধান কর, যে পর্যন্ত অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার উহাতে মিশ্রিত না হয়। হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যাহা ইচ্ছা ভক্ষণ কর এবং যাহা ইচ্ছা পরিধান কর; কিন্তু অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার যেন তোমাকে পথভ্রষ্ট না করে।
আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। সেই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতির উচিত সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলা। সেই বিধান তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তুমিই বলো না মা, মানুষের কি উচিত নয়, বিশ্ব প্রভু আল্লাহর বিধান মেনে চলা?
মাহবুবা তন্ময় হয়ে মরিয়ম খাতুনের কথা শুনছিল। এ রকম কথা আগে কখনো শোনেনি। বলল, হ্যাঁ চাচি আম্মা মেনে চলাই তো উচিত।
মরিয়ম খাতুন বললেন, তোমাকে আমি হেজবুন-নেশওয়ান, তাহারাতুন-নেশওয়ান ও একটা নামায শিক্ষার বই দেব। সেগুলো পড়ে সেইসব মেনে চলার চেষ্টা করবে। আর কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ইসলামের উপর বিভিন্ন বই পড়বে। তা হলে ইসলামকে যেমন জানতে পারবে তেমনি সেইসব মেনে চলারও প্রেরণা পাবে। আর সাংসারিক জীবনে যেমন সুখ-শান্তি পাবে তেমনি আখেরাতেও পাবে। আমি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসি তখন ধর্মীয় বিধি-বিধান যেমন জানতাম না তেমনি মেনেও চলতাম না। তোমার চাচা আমাকে সবকিছু শিখিয়েছেন। ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়বার অভ্যাস করিয়েছেন। সেই সব পড়ে জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মেনে চলারও প্রেরণা পেয়েছি। আর এটাও জেনেছি, যার মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান নেই, তাকে সেই জ্ঞান দান করা কর্তব্য। তুমি শিক্ষিত মেয়ে হলেও তোমার ধর্মীয় জ্ঞান নেই। তাই আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম। শিক্ষিত মেয়ে হিসাবে তুমি আমার কথাগুলো নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে কদমবুসি করে বলল, আপনি দোয়া করুন, আমি যেন আপনার কথা মতো কাজ করতে পারি।
মরিয়ম খাতুন তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, আল্লাহ তোমাকে দ্বীনকে বোঝার ও সেইমতো চলার তওফিক দেন। তারপর বললেন, মাহবুবকে তুমি কতটা জেনেছ জানি না, ও কিন্তু ধর্মীয় বিধানের বাইরে কোনো কিছু। করে না।
মাহবুবা বলল, তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরপরই তা আমি বুঝতে পেরেছি।
এমন সময় স্বামীকে বাজার থেকে ফিরতে দেখে মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমি বস। আমি দেখি তোমার চাচা কী বাজার করে এনেছেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে স্বামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বললেন, আপনি বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি আসছি। কথা শেষ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বরান্দায় এসে মাহবুবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, গ্রাম দেখতে যাওনি?
মাহবুবা বলল, চাচি আম্মার সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, বিকেলে যাব।
সুলতান খাঁন বললেন, জান মা, তোমার চাচি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। ধর্ম সম্বন্ধে একরকম কিছুই জানত না। কিন্তু এ বাড়িতে আশার পর বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে আমার থেকে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে। মাঝে মাঝে আমার ভুল-ত্রুটি হলে সংশোধন করে দেয়।