মাহবুবার পরিচয় জেনে মরিয়ম খাতুন নিশ্চিত হয়েছেন, এই মেয়েই মাহবুবকে পছন্দ করে এবং সেই জন্য তার অসুখের সময় সাহায্য করেছে। তাই হয়তো আমাদের সব কিছু দেখার জন্য এসেছে। তবু রাত্রে ঘুমাবার আগে গল্প করতে করতে এক সময় মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমিই তো মাহবুবকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছ, তাই না মা?
মাহবুবা বলল, আপনার ছেলে বুঝি তাই বলেছে?
শুধু তাই বলেনি, তুমি যে দিন রাত সেবা যত্ন করেছ, ক্লিনিকের টাকা দিয়েছ সব বলেছে। শুনে আমি তোমার জন্য অনেক দোয়া করেছি।
চাচি আম্মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দেবেন তো?
ওমা, মেয়ের কথা শোন, উত্তর দেব না কেন? কি জানতে চাও বল।
এবারে মাহবুব বাড়িতে আসার পর কি এমন ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য তার মন খুব খারাপ। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কিছু বলেনি।
মরিয়ম খাতুন স্বামীর কাছে জেনেছেন, পুকুর রেখে টাকা নেওয়ার কথা আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে মাহবুব শুনেছে। মাহবুবার কথা শুনে ভাবলেন, তাই হয়তো মন খারাপ। বললেন, না কোনো কিছুই ঘটেনি।
তা হলে মাহবুব সব সময় মন খারাপ করে থাকে কেন? আমার মনে হয় আপনি আমার কাছে গোপন করছেন।
মরিয়ম খাতুনের হঠাৎ মনে পড়ল, আলাউদ্দিন মীরের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা। ভাবলেন তা হলে কি আলাউদ্দিন মীর তাহেরাকে বিয়ে করার জন্য। মাহবুবকেও কিছু বলেছেন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাহেরার কথা চাপা দিয়ে বললেন, তোমার অনুমান ঠিক। ব্যাপারটা আমাদের পারিবারিক, তোমার না শোনাই ভালো। ঘরের কথা বাইরে কারো কাছে বলা নিষেধ। এটা হাদিসের কথা।
মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে নিজের মেয়ে মনে করে বলুন।
মরিয়ম খাতুন বলাটা ঠিক হবে কি না চিন্তা করতে লাগলেন।
মাহবুবা কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল, আমি যদি আপনাদের মেয়ে হতে চাই, তবু বলবেন না?
মরিয়ম খাতুন আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অতবড় ভাগ্য আমাদের কী হবে মা? মাহবুবের মুখে শুনেছি তুমি কোটিপতির একমাত্র মেয়ে। তুমি বললেও তোমার মা-বাবা রাজি হবেন কেন?
আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি তাদের মতামত নিয়েই এসেছি। আর তখন পাশের গ্রামে কাজের কথা যে বলেছি, তা সত্য নয়। মাহবুবের মন কেন খারাপ। তা জানার জন্যই এসেছি।
প্রথম থেকেই মাহবুবার কথাবার্তা ও আচার আচরনে মরিয়ম খাতুন অবাক হয়েছিলেন। এখন তার কথা শুনে যেমন আরো বেশি অবাক হলেন, তেমনি আনন্দিতও হলেন। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও দুগালে চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ গো, এই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের মনের বাসনা পুরণ করো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, এখন আর তোমাকে বলতে বাধা নেই। তারপর আলাউদ্দিন মীরের পরিচয় ও পুকুর সাফকবলা রেখে তার কাছ থেকে একলাখ টাকা নেওয়ার কথা বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে আমাদের সংসার বেশ ভাল ভাবেই চলে যায়। মাহবুবকে উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার চাচা টাকাটা নেন। তাকে জানালে রাজি হত না। তাই তখন জানান হয়নি। এবারে তোমার চাচা অসুখের জন্য টাকা আনতে যেতে পারেন নি। মাহবুবকে পাঠিয়ে ছিলেন। আলাউদ্দিন মীর তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে। ঐ পুকুরের ও পুকর পাড়ের বাগানের আয়ে আমাদের সংসার চলে। পুকুর ফেরৎ নেওয়ার আর মাত্র দুবছর সময় আছে। এর মধ্যে টাকা না দিতে পারলে পুকুর আলাউদ্দিন মীরের হয়ে যাবে। এই কথা চিন্তা করে মাহবুব হয়তো মন খারাপ করে থাকে।
এতক্ষণে মাহবুবার কাছে সব কিছু ক্লিয়ার হল। বলল, আমাকে যখন মেয়ে বলে গ্রহণ করে পরিবারের গোপন কথা জানালেন তখন মেয়ে হিসেবে আমিও আমার কর্তব্য করব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। চাচাকেও চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। আমি কালই ঢাকা ফিরে যাব।
সেকি হয় মা? মেয়ে হয়ে যখন এসেছ তখন মায়ের বাড়িতে এসেই কি যাওয়া যায়? তা ছাড়া যখন তোমার মা-বাবাকে বলেই এসেছ তখন আর দুচার দিন থাকতে অসুবিধা কোথায়?
ঠিক আছে, দুদিন থেকে তারপরের দিন যাব।
পরের দিন সকালে এক ফাঁকে মরিয়ম খাতুন স্বামীকে সব কথা জানালেন।
সুলতান খাঁন বললেন, আমি এরকমই অনুমান করেছিলাম। এই নিয়ে আর চিন্তা করে কি হবে? আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছে হবে।
নাস্তা খাওয়ার সময় মাহবুবা সুলতান খাঁনকে বলল, চাচা, মাহবুবের কাছে শুনেছি আপনাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। আরো শুনেছি আপনি খুব ভালো সাঁতারু। এখনো অনেক্ষণ সাঁতার কাটেন। আমি আপনার সাঁতার কাটা দেখব।
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, হ্যাঁ মা প্রতিদিন সাঁতার না কাটলে মনে শান্তি পাই না। জান মা, আমার আব্বা ও দাদা দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। শুধু তাই নয় খুব ভালো লাঠিয়ালও ছিলেন। মাহবুবকে আমিই সাঁতার ও লাঠিখেলা শিখিয়েছি। ওকে সাঁতারে ও লাঠি খেলাতে কেউ হারাতে পারে না।
মাহবুবা বলল, একথা আমিও জানি। ঢাকায় সাঁতার প্রতিযোগীতায় প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। এবছরও তিনটে স্বর্ণ পদক পেয়েছে। তবে লাঠিখেলা জানে জানতাম না।
সুলতান খাঁন আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করলেন। তারপর বললেন, তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রামটা ঘুরে দেখ। দুপুরে গোসল করার সময় তোমাকে নিয়ে যাব। তারপর স্ত্রীকে বললেন, বাজারের ব্যাগ দাও। কিছু মাংস নিয়ে আসি। গোসল করার সময় পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করব। মেয়ের ভাগ্যে থাকলে দুএকটা পড়ে যেতে পারে। শহরের বড়লোকের মেয়েকে তো আর ডাল ভাত খাওয়াতে পারি না।