সুলতান খাঁন কাছে এসে ড্রাইভারের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বললেন, কে আপনারা? যাবেন কোথায়?
মাহবুবা মাহবুবের মুখে তার মা ও বাবা দেখতে কেমন তাও শুনেছিল। সট নেওয়ার পর ভালোভাবে দেখে বুঝতে পারল, ইনিই মাহবুবের বাবা। তাই ড্রাইভার বলার আগে সালাম দিয়ে বলল, আমরা ঢাকা থেকে মাহবুবদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মাহবুবকে চেনেন?
জ্বি চিনি। আপনি নিশ্চয় মাহবুবের বাবা?
হা মা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনাদেরকে তো চিনতে পারছি না?
আমাদেরকে তো কখনো দেখেননি, চিনবেন কি করে? আমার বাবার নাম আনিসুর রহমান। উনি একজন ব্যবসায়ী। ঢাকাতেই আমাদের বাড়ি। তারপর ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলল, উনি অনেক বছর ধরে আমাদের গাড়ি চালান। আমি ভার্সিটিতে পড়ি। মাহবুবের সঙ্গে ভালোভাবে জানা শোনা আছে।
সুলতান খাঁন ভাবলেন, তা হলে কি এই মেয়েটাই মাহবুবের অসুখের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল? তারপর ড্রাইভারকে বললেন, আপনি কাঁচারী ঘরের ভিতরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি। তারপর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আসুন।
মাহবুবা যেতে যেতে বলল, আমি তা আপনার মেয়ের বয়সি, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমার নাম মাহবুবা। নাম ধরে তুমি করে বলবেন।
ততক্ষণে তারা বাড়ির উঠোনে এসে পড়েছেন। সুলতান খাঁন একটু জোরে বললেন, জমিরন কোথায়রে মা, তোর চাচিকে ডাক।
জমিরন চাচির সঙ্গে নামায পড়ছিল। মোনাজাতের পর চাচার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সঙ্গে একটা আপটুডেট মেয়ে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, কিরে মা, কি দেখছিস? ঢাকার খুব বড় লোকের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তোর চাচি কোথায়?
ততক্ষণে মরিয়ম খাতুন নামায শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন। স্ত্রীকে দেখে বললেন, মা আমার ঢাকা থেকে এসেছে। কিছু খেতে দাও। তারপর জমিরনকে বললেন, তুই মুখ হাত ধোয়ার পানি দে। আমি কাঁচারী বাড়িতে ড্রাইভারের কাছে যাচ্ছি।
নাস্তা খেতে দিয়ে মরিয়ম খাতুন মাহবুবার সঙ্গে আলাপ করার সময় তার নাম শুনে বুঝতে পারলেন, এই মেয়েই মাহবুবকে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছে। মনে মনে খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুবের সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
তা প্রায় আট নয় মাস হবে।
তুমি আসবে মাহবুব জানে?
জ্বি না।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?
মাহবুবা বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি একটা বিশেষ কাজে পাশের গ্রামে এসেছিলাম। মাহবুবের কাছে আপনাদের কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম, দেখা করে একদিন বেড়িয়ে যাই।
খুব ভালো করেছ মা। আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের মাহবুব ও মাহফুজা ছাড়া কেউ নেই। এতবড় বাড়িটা খা খা করে। কারো সঙ্গে দুটো কথা বলতেও পাই না। জমিরনটা আছে বলে তবু রক্ষে।
মাহফুজা কে চাচি আম্মা?
আমার বড় মেয়ে। মাহবুবের চেয়ে ছয় বছরের বড়। অনেক দূরের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছরে একবার এসে যে কয়েক দিন থাকে, সেই কয়েক দিন বেশ ভালই কাটে। তারপর খুব খারাপ লাগে।
ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌ আনুন। তাহলে তো আর খারাপ লাগবে না।
সময় হলে তাতো আনবই। এখন ওকে বিয়ের কথা বলাই যাবে না।
কেন? আপনার কষ্ট হচ্ছে, সেকথা জানিয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বললে কিছু শুনবে না?
ও আমাদের কথার কখনো অবাধ্যতা করেনি। বললে বরং মাথা হেঁট করে মেনে নেবে। তাই বলে পড়াশোনা বন্ধ করে কী বিয়ে দেওয়া উচিত? তা ছাড়া পড়াশোনা শেষ করে রুজী রোজগার করুক, তারপর আর দেরি করব না।
কথা বলতে বলতে মাগরীবের আযান হতে মরিয়ম খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি। কী নামাজ পড়বে?
মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, আমি নামায পড়তে জানি না।
ঠিক আছে তুমি বস, আমরা নামায পড়ে নিই।
মাহবুবের বিয়ে হয়নি শুনে মাহবুবার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। বসে বসে চিন্তা করতে লাগল, তা হলে কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? ভেবে রাখল বুদ্ধি করে তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নেবে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন মাহবুবাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অন্য। রুমে একা ঘুমাবে, না আমার রুমে ঘুমাবে?
গ্রামের রাতের নিস্তব্ধতা মাহবুবা কখনো অনুভব করেনি। সন্ধ্যার পর আশ পাশের। বাড়ির কিছু কোলাহল শোনা গেলেও রাত যত বাড়ছে, নিস্তব্ধতাও তত বাড়ছে। দুবছর আগে বিদ্যুৎ এলেও বাড়ির বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বারান্দায় একটা ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোয় উঠোনের অর্ধেক দেখা যায়। মাহবুবা আলো ঝলমলে শহরে মানুষ। সন্ধ্যার পর থেকে তার গা ছমছম করছে। এতবড় বাড়িতে তাদের দুজনকে নিয়ে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। মরিয়ম খাতুনের কথা শুনে বলল, আমি আপনার রুমে ঘুমাব। আপনার কাছে গ্রামের গল্প শুনব।
সুলতান খাঁনের এক তলা ছয় কামরা পাকা বাড়ি। আর সদরের দিকের টিন সেড একটা কাঁচারী বাড়ি। এ বাড়িটা তার দাদা বাদশা খান করেছিলেন। সুলতান খাঁনের বাবা রুস্তম খান একবার সংস্কার করেছিলেন। অর্থাভাবে সুলতান খাঁন করাতে পারেন। নি। তাই বাইরের দিকে দেওয়ালে অনেক জায়গায় প্লাস্টার উঠে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতর সাইড ভালো থাকলেও অনেক জায়গায় চুন উঠে গেছে। তবে যে তিনটে রুম ব্যবহার হয়, সেগুলোর ভিতরসাইড চুনকাম করেন। এই তিনটে রুমের একটায় সুলতান খাঁন ও তার স্ত্রী থাকেন। বাকি দুটোর একটাতে মাহবুব আর অন্যটা মেয়ে জামায় এলে থাকে। অন্য সময় তালামারা থাকে। অন্য তিনটে রুমের একটায় জমিরণ থাকে। বাকি দুটো খালি পড়ে থাকে।