না দাদু রাগ করব কেন? আমি এক বাড়িতে দুটো ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াই। সেখানে লজিং পেয়ে গেছি।
নজুমিয়া ম্লান মুখে বললেন, তা হলে তো বাধা দিতে পারি না। এই একমাস এসে আপনি আমাদেরকে কোরআন হাদিস শুনিয়ে নামায ধরিয়েছেন। অনেককে কোরআন পড়তে শিখিয়েছেন। আপনাকে পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি। চলে যাবেন শুনে খুব খারাপ লাগছে।
মাহবুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কি করব দাদু মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখবেন দাদু, দুনিয়াটা মুসাফির খানা। দুদিন আগে পরে সবাইকে চলে যেতে হবে।
হ্যাঁ ভাই, আপনি খুব দামি কথা বলেছেন। মাঝে মাঝে এলে সবাই খুশি হব।
ইনশাল্লাহ আসব।
দুদিন পর মাহবুব মেস ছেড়ে দিয়ে রুনাদের বাসায় চলে এল।
.
মাহবুবা তিন চার দিন পর মাহবুবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আজিমপুর মেসে গেল।
নজুমিয়ার শরীর খারাপ থাকায় আজ অফিসে যাননি। আসরের নামায পড়ার জন্য অজু করছিলেন। মাহবুবাকে দেখে বললেন, দুদিন আগে এলে দেখা পেতেন। পাখী পরশু উড়াল দিয়েছে।
মাহবুবা চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিকানা জানেন?
উড়াল দেওয়া পাখির ঠিকানা জানব কি করে?
ধন্যবাদ জানিয়ে মাহবুবা ফিরে এল। তারপর কয়েক দিন চিন্তা করে ঠিক করল, মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা জানবে।
একদিন খাওয়ার টেবিলে আনিস সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মা, তোর কি কোনো অসুখ বিসুখ করেছে? বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি সব সময় মন খারাপ করে থাকিস। খাওয়া দাওয়াও ভালোভাবে করিস না।
মাহবুবা বল, অসুখ বিসুখ করেনি, তবে একটা প্রবলেমে পড়েছি। সলভ করতে পারছিলাম না। এতদিন চেষ্টা করে ফরমুলাটা মাথায় এসেছে।
তা হলে দেরি করছিস কেন?
সবে মাত্র কাল এসেছে। বাবা, আমি মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে একবার যেতে চাই।
আনিস সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন কেন?
প্রবলেম সল্ভ করার জন্য।
আমার মনে হয় তোর ফরমুলাটা রং প্রবলেমটা বল, অন্য ফরমুলায় সলভ করার ব্যবস্থা করব।
মাহবুব সুস্থ হয়ে মাস দুয়েক আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় আমাকে বলে যাই নি। পনের দিন পরে ফিরে আসে। তারপর থেকে আমার সাথে দেখা করেনি। আমি তার মেসে গিয়েও দেখা পাইনি। সপ্তাহ খানেক পরে ঐ মেস ছেড়ে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তার ঠিকানা পাইনি। কয়েক দিন আগে দৈবক্রমে তার ঠিকানা পেয়ে দেখা করি। কিন্তু কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। দুতিন দিন আগে আবার তার কাছে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম ওখান থেকেও পালিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আনিস সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, আমার মতে তোর সেখানে না যাওয়াই ভালো। গিয়ে হয়তো নতুন বৌ দেখতে পাবি। গ্রামের ছেলেরা শহরের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করলেও গ্রামের মেয়েকেই বিয়ে করে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু একবার গিয়ে আমি আসল ঘটনা জানতে চাই।
কিন্তু মা, দূরের পথ, একা একা যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া তুই কখনো গ্রামে যাসনি। কতরকমের অসুবিধা হবে। কোথায় উঠবি, কোথায় থাকবি, চিন্তা করবি না? গ্রামে তো আর আবাসিক হোটেল নেই যে থাকবি। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি যাবে কি না তারও ঠিক নেই। অনেক অসুবিধায় পড়বি।
সেখানে শামীমা বেগম ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাগলামী করিস না মা। তোর বাবা ঠিক কথাই বলেছেন, কোনো বিপদ হলে কে। তোকে সাহায্য করবে?
তোমরা ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। মাহবুব যখন ক্লিনিকে ছিল তখন তার কাছে। শুনেছি গ্রামের লোকজন খুব সরল-সোজা। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করে। ওর মা-বাবা খুব ভালো। ওদের কাঁচারী বাড়ির সামনে দিয়ে বড় রাস্তা। গাড়ি সরাসরি ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাবে। তোমরা দেখ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ড্রাইভার চাচাতো থাকবেন। তিনিও তো গ্রামের মানুষ।
আনিস সাহেব বললেন, নিষেধ যখন শুনবি না তখন আর বাধা দেব না। তবে কথা দে, আমাদের অনুমান যদি সত্য হয় তা হলে আমাদের কথা মেনে নিবি?
আমি কি কোনো দিন তোমাদের কথার অবাধ্য হয়েছি?
তা হস্নি, শুধু এই ব্যাপারটা ছাড়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আই উইশ ইউর। গুড লাক। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি মাহবুবদের বাড়িতেই উঠবি?
হ্যাঁ বাবা।
কবে যেতে চাস?
দুএক দিনের মধ্যে।
আমি ড্রাইভারকে কে যা বলার বলে দেব।
.
০৬.
মাহবুবা যখন মাহবুবদের কাঁচারী বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখন সুলতান খাঁন আসরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছেন। দুর থেকে কাঁচারী বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামতে দেখে বেশ অবাক হলেন। আজ দুপুরে মাহবুবের চিঠি পেয়েছেন। লিখেছে সে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় করছে তাকে আর টাকা পাঠাতে হবে না।
সুলতান খাঁন গাড়ির কাছে আসার আগে মাহবুবা ও ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেছে। মাহবুবা জীবনে এই প্রথম কোনো গ্রামে এল। মাহবুবের কাছে গ্রামের বাড়ি ও বাড়ির চারপাশের বর্ণনা শুনেছিল। আসার সময় গাড়ি থেকে মাঠ-ঘাট, বাড়ি-ঘর ও গাছপালা দেখে তার মন আনন্দে ভরে গেছে। এখন গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের গাছ-গাছালি ও গ্রাম্য পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হল। তন্ময় হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল। লুংগী-পাঞ্জাবী ও মাথায় টুপি পরা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান একজন প্রৌঢ় লোককে তাদের দিকে আসতে দেখে ফটো তোলার লোভ সামলাতে পারল না। গ্রামের সিনারী তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সেটা কাঁধে ঝুলিয়েই গাড়ি থেকে নেমেছে। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা ফিট করে একটা সর্ট নিল।