মাহবুবা চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ আমি। তা চমকে উঠলে কেন? ভয়ে, না অবিশ্বাস্য কিছু দেখে?
মাহবুব কিছু না বলে মুখ নিচু করে নিল।
মাহবুবা আবার বলল, ভেবেছ ভেশ বদলে আমাকে ফাঁকি দেবে। তা কখনোই পারবে না। যার নাম আমার শরীরের রক্ত কণিকার সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা প্রবাহিত হচ্ছে, সে আমাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যা কিছু করুক না কেন, পারবে না। একটু বসতেও বলবে না?
মাহবুব তার কথার উত্তর না দিয়ে ব্রীফকেস খুলে টাকার বান্ডিল এনে তার দিকে বাড়িয়ে বলল, অসুখের সময় যা কিছু করেছ সে জন্য চির কৃতজ্ঞ থাকব। ক্লিনিকের বিলটা নিয়ে চলে গেলে খুশি হব।
মাহবুবা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, মাহবুব তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি যে নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
মাহবুবার অবস্থা দেখে মাহবুবের মন বিচলিত হয়ে উঠল। নিজেকে কঠোরভাবে। সামলে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল, টাকাটা নিয়ে চলে যাও, আর কখনো এস না।
মাহবুবা শরাহত হংসের মতো ককিয়ে উঠল, কিন্তু কেন মাহবুব কেন? আমি কি এমন অন্যায় তোমার কাছে করেছি?
অন্যায় করেছ সে কথা তো বলিনি। বলেছি চলে যেতে, কারণ যাওয়াটাই তোমার জন্য মঙ্গল।
আর যদি বলি অমঙ্গল?
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, বেশ চলে গেলে যদি খুশি হও, তা হলে শুধু এখান থেকে নয়, এই পৃথিবী থেকে একেবারে চিরজীবনের জন্য চলে যাব।
মাহবুব আবার চমকে আতঙ্কিত স্বরে বলল, ছিঃ মাহবুবা, এমন কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। আমি একটা কাপুরুষ! একটা কাপুরুষের জন্য তুমি নিজের সর্বনাশ করবে কেন?
নিজেকে কাপুরুষ বলতে বিবেকে বাধল না?
বিবেক নেই বলেই যে বললাম এই কথাটা বুঝতে পারছ না কেন? প্লীজ চলে যাও। এটা মেস এখানে কত রকমের লোক আছে। এতক্ষণে হয় তো উঁকি ঝুঁকি মারছে? নানা রকম মন্তব্য করছে।
তুমি কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ বললেই চলে যাব।
সেকথা বলতে পারব না বলেই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
ঠিক আছে, আজ চলে যাচ্ছি কিন্তু যতদিন কারণটা না বলবে ততদিন বারবার আসব। তারপর চোখ মুখ মুছে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল, বেশ কয়েকজন দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল।
যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা এবার রুমে ঢুকে মাহবুবকে ঘিরে ধরে বলল, কি ব্যাপার ব্রাদার? ঘটনা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়?
মাহবুব বুঝতে পারল এতক্ষণ এরা আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেছে। তাই বিরক্ত না হয়ে বলল, বড় লোকের মেয়ের খামখেয়ালী আরকি। দেখুন না, শহরের এত কোটিপতির ছেলে থাকতে কিনা অজ পাড়াগাঁয়ের এই হতভাগার পিছু লেগেছে।
তাদের মধ্যে নজুমিয়া নামে এক বয়স্ক লোক ছিলেন। তাকে সবাই দাদু বলে ডাকে। খুব রসিক মানুষ। তিনি বললেন, আরে ভাই পিছু লেগেছে যখন ঝুলে পড়ুন। কোটিপতির মেয়েকে বিয়ে করে আপনিও কোটিপতি হয়ে যান। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা যাই বলুন, নাত বৌ কিন্তু খুব সুন্দরী। মাহবুব দাদুর সঙ্গে মানাবে ভালো।
মাহবুবের মনের অবস্থা খুব খারাপ। হাতজোড় করে বলল, আপনারা দয়া করে এখন যান, আমি নামায পড়তে যাব।
মাহবুবের কথা শুনে সবাই চলে গেল। নজুমিয়া সবার শেষে যাওয়ার সময়। বললেন, এভাবে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।
মাহবুব কোনো কথা না বলে রুমে তালা দিয়ে মসজিদে গেল।
রাতে ঘুমাবার সময় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, দুএক দিনের মধ্যে অন্য কোনো মেসে চলে যাবে।
পরের দিন সকালে প্রাইভেট পড়াতে এলিফেন্ট রোডে গেল। ছাত্রটির নাম রাসেল, সে নাইনে পড়ে। ছাত্রীটির নাম রুনা। সে টেনে পড়ে। আজ পড়ানো হয়ে যেতে রুনা বলল, স্যার একটু বসুন। তারপর বইপত্র গুছিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে রুনার সঙ্গে তার মা এসে বেতনের টাকা দেওয়ার সময় বললেন, আপনার টিচিং খুব ভালো। মাত্র এক মাসের মধ্যে ওদের পড়ার খুব উন্নতি হয়েছে তাই আমরা খুশি হয়ে এই মাস। থেকেই তিন হাজার টাকা দিলাম। তারপর বললেন, রুনার আব্বার কাছে শুনলাম। আপনি ইংলিশে মাস্টার্স করছেন। আরো শুনলাম মেসে থাকেন। মেসে বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকে। সেখানে নিশ্চয় ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারেন না। তাই বলছিলাম কি আপনার অসুবিধা না থাকলে এখানে থাকুন। ছেলেমেয়ে দুটো আপনার খুব ভক্ত। হয়ে পড়েছে। আপনাকে কথাটা বলার জন্য প্রতিদিন তাগিদ দেয়। ফাস্ট ফ্লোরে। দুতিনটে গেস্ট রুম আছে। পছন্দ মতো যে কোনো একটায় থাকতে পারেন। আমাদের সঙ্গেই খাবেন।
এত তাড়াতাড়ি এমন সূবর্ণ সুযোগ আল্লাহ পাইয়ে দেবেন মাহবুব কল্পনা করতে পারেনি। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করার সময় চোখে পানি আসার উপক্রম হল। মুখ নিচু করে সামলে নিয়ে বলল, আমার আপত্তি নেই, তবে আমি পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকব।
সে ব্যাপারে রুনার আব্বার সঙ্গে কথা বলবেন। আপনি দুএক দিনের মধ্যে চলে আসুন।
ঠিক আছে, এখন আসি বলে মাহবুব সালাম বিনিময় করে চলে এল।
মাহবুব যে মেসে থাকে সে মেসের পুরো দায়িত্ব নজু মিয়ার উপর। ঐদিনই মাহবুব নজুমিয়াকে ডেকে চলতি মাসের ভাড়া দিয়ে বলল, আমি কাল এখান থেকে চলে যাব। নজুমিয়া অবাক হয়ে বললেন, আপনি কী আমাদের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?