আনিস সাহেব স্ত্রীকে কিছু না বলার জন্য ইশারা করে বললেন, কিন্তু মা, এই কাজ খুব কঠিন। যেমন সময়ের দরকার তেমনি ধৈর্য্যেরও দরকার। তুই কী পারবি?
আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর পারব। তোমরা এত শিঘ্রী আমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছ কেন? মাস্টার্স না করে আমি বিয়েই করব না। ততদিনে মাহবুবকে তৈরি করে নেব।
ঠিক আছে, আমরাতো বলেছি তোর অমতে কিছু করব না।
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, কথাটা মনে রাখলে খুশি হব। তারপর চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুব দুদিনের জন্য দেশে। গিয়ে দুই সপ্তাহ ছিল, ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে ঘা ঢাকা দিল। তা হলে কী মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে? তাই বোধ হয় মাসুম। ভাইকে কোনো কথা জানাতে নিষেধ করে পালিয়েছে। আবার ভাবল, মাহবুবের মতো ছেলে এরম কাজ কিছুতেই করতে পারে না। যদি দৈব ঘটনায় বিয়ে করেই থাকে সে। কথা জানাবার সৎ সাহস তার আছে। তবু কেন দেখা না করে পালাল? তা হলে কি অন্য কোনো সমস্যায় পড়েছে? সিদ্ধান্ত নিল যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করবেই। প্রয়োজনে তার গ্রামের বাড়িতে যাবে।
.
মাহবুব আজিমপুর আসার পর দাড়ি রেখেছে। বাইরে বেরোবার সময় সানগ্লাস ব্যবহার করে, যাতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও যেন মাহবুবা চিনতে না পারে। প্রায় মাসখানেক পর একদিন বিকেল চারটার দিকে মাসুমের সঙ্গে দেখা করতে গেল। রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কিরে কেমন আছিস? চিনতে পারছিস তো?
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, কেমন আছি বলব না। তবে চিনতে, পারার কথা যে বললি, তার উত্তরে বলব, তুই যতই ভেশ বদল করিস না কেন, আমার
চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। তারপর বলল, তুই একদিন আমাকে নীরেট বোকা গাধা বলেছিলি। তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেদিন আমিও তোকে তাই বলেছিলাম। কিন্তু আজ তোকে দেখে সত্যি সত্যি তাই মনে হচ্ছে। আরে নীরেট বোকা গাধা, মাহবুবাকে তুই ভালবাসলেও তাকে সম্পূর্ণ চিনতে পারিসনি। পারলে তার কাছ থেকে পালাতিস না। আমি তাকে যতটুকু জেনেছি তাতেই বুঝেছি তুই তার সারা মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছিস। আজীবন সে তোর প্রত্যাশায় থাকবে। তার সঙ্গে দেখা করা তোর একান্ত উচিত। তুই চলে যাওয়ার পর কিভাবে যে আমার দিন কেটেছে তা আল্লাহ পাক জানেন। এক সপ্তাহ দিনে রুমে থাকতাম না। সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে রাতে ফিরে আসতাম। আর এদিকে মাহবুবা প্রায় প্রতিদিন এসে রুমে তালা দেখে ফিরে গেছে। একদিন সন্ধ্যার পর এসে হাজির। তারপর যেসব কথাবার্তা হয়েছিল বলে বলল, সেদিন মাহবুবার মুখের অবস্থা দেখে তোর প্রতি আমার যতটা রাগ হয়েছিল। এখন তোকে দেখে সেই রাগ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তুই এক্ষুণী আমার সামনে থেকে চলে যা নচেৎ কিছু একটা করে ফেলব।
মাহবুব খুব অবাক হয়ে বলল, মাসুম, এ তুই কী বলছিস?
মাসুম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কানে নিশ্চয় কম শুনিস না। যা বললাম তাই কর। তোর মতো কাপুরুষের মুখ আমি দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে চলে যা, আর কখনো আসবি না।
মাহবুব আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা মনে রাখিস, আমি যা কিছু করছি মাহবুবার ভালোর জন্য। তুই আমাকে ভুল বুঝবি তা কোনোদিন ভাবিনি।
তোর কোনো কথাই শুনতে চাই না, তুই চলে যা।
মাহবুবের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তায় এসে একটা খালি স্কুটার দেখতে পেয়ে আজিমপুর যেতে বলে উঠে বসল।
মাহবুবা এই একমাস মাহবুবকে ভার্সিটিতে, লাইব্রেরীতে, স্টেডিয়ামে ও বিভিন্ন। জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছে। আজ হঠাৎ তার মনে হল, মাসুমের কাছে হয়ত মাঝে মাঝে যায়। সেখানে একবার খোঁজ নিলে কেমন হয়। ভাগ্য ভালো হলে দেখাও হয়ে যেতে পারে। এই কথা চিন্তা করে আজ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে স্বামীবাগ রওয়ানা দিল।
মাহবুবার গাড়ি যখন হাটখোলা পার হয়ে টিপুসুলতান ও নারিন্দা রোডের মোড়ে এল তখন মাহবুবের স্কুটার নারিন্দা রোড থেকে টিপুসুলতান রোডে মোড় নিচ্ছে। সে সামনে বসেছিল। মাহবুবের মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস থাকা সত্বেও চিনতে পেরে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে মাহবুবের স্কুটারের দিকে নির্দেশ করে ড্রাইভারকে বলল, ঐ মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরা ছেলেটার স্কুটারকে ফলো করুন।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে স্কুটারকে ফলো করে চলল।
মেসের কাছে পৌঁছে মাহবুব স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটতে লাগল।
মাহবুবার ড্রাইভার অল্প দূরে গাড়ি থামিয়েছে। মাহবুবা ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবকে ফলো করে তার রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল।
মাহবুব মাসুমের কাছে এমন দুর্ব্যবহার পাবে কল্পনাও করেনি। সারা পথ উদভ্রান্তের মতো এসেছে। রুমে ঢুকে চুপ করে বসে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুবা নিশ্চয় তাকে এমন কিছু বলেছে যে জন্য মাসুম তার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করল।
মাহবুবের চিন্তাক্লিস্ট মলিন মুখ দেখে মাহবুবার মন বিচলিত হলেও কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
এমন সময় আসরের আযান শুনে মাহবুব দাঁড়িয়ে দরজার দিকে নজর পড়তে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, তুমি?