মাসুম সালামের উত্তর দিতে ভুলে গিয়ে হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
৫. কাঁচারীতে বসে
০৫.
আলাউদ্দিন মীর একদিন সুলতান খাঁনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
সুলতান খাঁন এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। কাঁচারীতে বসে একজন কামলাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আলাউদ্দিন মীরকে আসতে দেখে তাকে কাজ করতে যেতে বললেন।
আলাউদ্দিন মীর কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার অসুখের কথা শুনেছিলাম, কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?
সুলতান খাঁন তাকে বসতে বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভাল। আপনি কেমন আছেন?
সংসারের ঝামেলায় ভালো আর থাকতে পারছি কই। নানান ঝামেলায় একরকম কেটে যাচ্ছে। তা মাহবুব কোথায়?
সে তো কয়েকদিন আগে ঢাকা চলে গেছে। টাকার ব্যাপারে মাহবুব কী আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল?
প্রথমে করেনি। আমি যখন টাকা দিয়ে বললাম, তোমার আব্বাকে বলো এটাই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই। তখন জিজ্ঞেস করল, আপনার কাছে আব্বার কিসের টাকা পাওনা ছিল? আমি আপনার পুকুর সাফকবলা রাখার কথা বললাম। আমার কথা শুনে মাহবুবকে খুব অবাক হতে দেখলাম। সে কী ব্যাপারটা জানত না?
সুলতান খাঁন চিন্তিত মুখে বললেন, জানালে লেখাপড়া করত না ভেবে জানাইনি। তারপর বললেন, জানানটা ঠিক হয়নি আপনার। কয়েক মাস পরে পরীক্ষা। আমার তো ভয় হচ্ছে লেখাপড়া বন্ধ করে না দেয়।
আপনার কথাই ঠিক, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। তবে আপনি যা ভাবছেন তা নাও করতে পারে। কয়েক মাস পরে যখন পরীক্ষা বললেন, তখন পরীক্ষা সে দেবেই। তারপর হয়তো বন্ধ করে দিতে পারে। মাহবুব হিরের টুকরো ছেলে। দেখবেন, এবারেও ভালো রেজাল্ট করবে।
আপনি টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে ওকে এতদূর লেখাপড়া করাতে পারতাম না।
কি যে বলেন, টাকা পয়সা থাকলেই যদি লেখা পড়া হত, তা হলে আমার ছেলেদের কেন হল না? আসলে মাথা ভালো হতে হবে। এই দেখুন না, আমার মেয়ে। তাহেরা, তার মাথা ভালো, তাই এক চান্সে বি. এ. পাস করে ফেলল। এবার বিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
তা দিচ্ছেন না কেন? ওর মতো মেয়ের পাত্রের অভাব আছে নাকি? ভালো ছেলে দেখে এবার ব্যবস্থা করুন।
পাত্রের তো অভাব নেই। রোজ একটা না একটা সম্বন্ধ আসছেই। কিন্তু মা আমার রাজি হচ্ছে না।
সে কি? রাজি হচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করেন নি?
বাবা হয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করি কি করে? ওর মা জিজ্ঞেস করতে বলেছে, সে মাহবুবকে পছন্দ করে। কথাটা কয়েকদিন আগে ওর মা আমাকে বলল। এখন আপনাদের উপর সব কিছু নির্ভর করছে। আগে জানতে পারলে মাহবুবের লেখাপড়ার সব খরচ আমিই দিতাম। আপনাকে দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে হত না। যা হওয়ার হয়েছে। আপনাদের মতামত পেলে দুএক দিনের মধ্যে দলিল ফিরিয়ে দেব। আর মাহবুবের লেখাপড়া শেষ করতে যা লাগবে সব দেব। জানেন তো, তাহেরা পাঁচ ভাইয়ের এক বোন। মাহবুব শিক্ষিত বলে তারা তাকে খুব সম্মান করে। ছোট বোনের স্বামী হলে মাথায় করে রাখবে। বিয়ের সময় যৌতুক যা দেওয়ার তা তো দেবই, তা ছাড়াও দশ বিঘে জমি মাহবুবের নামে লিখে দেব।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের সাহস দেখে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।
আলাউদ্দিন মীর তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, আমার কথায় আপনি মনে কিছু নেবেন না। আমার মনে হয় প্রস্তাবটা মেনে নিলে আমাদের উভয়েরই মঙ্গল হবে। তবু যখন সুলতান খাঁন কিছু বললেন না তখন আবার বললেন, এখন কিছু বলার দরকার নেই, মাহবুবের মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এক সময় জানাবেন। এখন আমি তা হলে আসি বলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বাড়ির ভিতরে এসে স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথাগুলো বললেন।
মরিয়ম খাতুন খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। স্বামী রেগে আছেন বুঝতে পেরে বললেন, ছেলে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে পাঁচ জায়গা থেকে তো সম্বন্ধ আসবেই। এতে কিছু মনে করার কি আছে। আর আলাউদ্দিন মীরের মেয়েকে দোষ দেওয়া যায় না। বরং মাহবুবকে পছন্দ করে সে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলে জানা যাবে, এই গ্রামে আরো কত মেয়ে বা তাদের মা-বাবা মাহবুবকে পছন্দ করে। তারা হয়তো সাহস করে প্রস্তাব দিতে পারছেন না। আর একটা কথা, আজকাল শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে। তাহেরা শিক্ষিত মেয়ে। সে হয়তো মাহবুবকে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পারে। অথবা আগের থেকে তাদের দুজনের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। নচেৎ তাহেরা তার মাকে পছন্দের কথা বলতে পারত না।
সুলতান খাঁন ভারি গলায় বললেন, তোমার কথা যুক্তি সঙ্গত। কিন্তু মন দেওয়া নেওয়ার কথা যে বললে, তা বিশ্বাস হয় না। মাহবুব এরকম কাজ করতেই পারে না। এসব আলাউদ্দিন মীরের চালাকি। ওযে কত ঘুঘু তা আমার বুঝতে বাকি নেই। আমাকে সম্পত্তি ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে সমাজে বড় হতে চায়।
আমিও তোমার সঙ্গে একমত। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি। যাক, এখন এ ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। মাহবুব এবারে এলে আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। আলাউদ্দিন মীরকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করলে বলো, আগে মাহবুব লেখা পড়া শেষ করুক তারপর তার সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবে।