সে কথা আমাকে বলছিস কেন? তাকে বললেই পারতিস।
তা আর বলিনি; কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার ধারণা, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তুই না জানিয়ে গেছিস।
কেউ যদি ভুল ধারণা করে, সেজন্যে তুই আমাকে দোষী করছিস কেন? যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তারপর টাকার বান্ডিল বের করে তা থেকে দুহাজার নিয়ে বাকি টাকা মাসুমের হাতে দিয়ে বলল, ক্লিনিকের বিলের টাকা। মাহবুবা এলে দিয়ে দিবি।
মাসুম বলল, আমি দেব কেন? তুই দিবি।
আমি দিলে নেবে না।
আর আমি দিলে বুঝি নেবে?
আমি যখন থাকবো না তখন দিবি। না নিতে চাইলে যুক্তি দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবি।
মাসুম চিন্তা করে দেখল, মাহবুবের কথাটা ঠিক। বলল, ঠিক আছে, চেস্টা করব। না নিলে আমাকে দোষী করবি না বলে রাখছি।
মাহবুব আর কিছু বলল না।
পরের দিন ক্লাস করে মাহবুব মেসে ফিরল না। প্রায় ঘন্টা তিনেক লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করল। তারপর কয়েকজন জানা শোনা ছেলের সঙ্গে দেখা করে প্রাইভেট ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে দিতে বলে সন্ধ্যের সময় ফিরল।
মাসুম জিজ্ঞেস করল, সারাদিন কোথায় ছিলি?
একটা কাজে কয়েক জায়গায় যেতে হয়েছিল।
কাজটা কি শুনি?
পরে শুনিস, এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
তোর কি হয়েছে বলতো?
এবারে বাড়ি থেকে ফিরে তোকে যেন কেমন মনে হচ্ছে। তোর বাবার অবস্থা কী ভালো নয়?
নারে আব্বা ভাল আছেন। মন খারাপ অন্য কারনে।
সেই কারণটা বলছিস না কেন?
বলার মতো হলে তুই জিজ্ঞেস করার আগেই বলতাম। এখন আমার কথা বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দে।
তা না হয় দেব; কিন্তু তোর মাহবুবা কাল এলে কি বলব? আজ প্রায় দুঘন্টা তোর জন্য অপেক্ষা করে গেছে। টাকা দিতে গিয়েছিলাম, নিল না। জিজ্ঞেস করল, কিসের টাকা? বললাম, মাহবুবের ক্লিনিকের বিল। বলল, যার টাকা সে দিলে নেব। কাল এই সময় আসব, আপনার বন্ধুকে থাকতে বলবেন। তারপর আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
তাকে বলিস, কয়েকদিন আমি খুব ব্যস্ত থাকব, সে যেন না আসে। পরে আমিই তার সঙ্গে দেখা করব। তারপর মাসুমের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ব্রীফকেসে তুলে রাখল।
তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করিস?
একথা বলতে পারলি?
তা হলে কি হয়েছে বলছিস না কেন?
বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করবি না। বললাম না, বলার মতো হলে আগেই বলতাম? তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। একটু সামলাতে দে, তারপর বলব। তোকে বলব না তো কাকে বলব। তোর কাছে একান্ত অনুরোধ, আমি না বলা পর্যন্ত কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
মাসুম আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে তাই হবে।
পরের দিন বেলা তিনটের সময় মাহবুবা মেসে এসে মাসুমকে একা দেখে সালাম দিয়ে বলল, এখনো মাহবুব ফেরেনি?
মাসুম বলল, না ফেরেনি।
আমি যে প্রতিদিন আসি, সে কথা তাকে বলেন নি?
বলেছি। তারপর মাহবুব যা বলতে বলেছিল, বলল।
ব্যস্ততার কারণ আপনাকে কিছু বলেনি?
না। জিজ্ঞেস করতে বলল, ব্যস্ততা কমলে নিজেই বলবে। তার আগে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছে।
ঠিক আছে, কয়েক দিন পরে আসব বলে মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে। ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, বাড়িতে গিয়ে মাহবুবের কী এমন হল, যে কারণে আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করছে না।
আট দশ দিনের মধ্যে মাহবুব এক সহপাঠির মাধ্যমে এলিফেন্ট রোডে নাইন টেনের দুটো ছাত্র-ছাত্রী পেল। সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে। বেতন দুহাজার টাকা। দুতিন মাসের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার উন্নতি দেখাতে পারলে আরো এক হাজার বাড়িয়ে দেবে।
মাহবুব সহপাঠিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে মসজিদে গিয়ে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ল, তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর আজিমপুরে এক মেসে থাকার ব্যবস্তা করে রাত আটটায় ফিরে এল।
মাসুম পড়ছিল। পড়া বন্ধ করে বলল, আর কতদিন ব্যস্ত থাকবি?
আল্লাহর রহমতে আজই শেষ বলে মাহবুব বই পত্র গুছিয়ে বাঁধতে শুরু করল।
কিরে এসব কি করছিস?
কি করছি দেখতেই তো পাচ্ছিস।
কিন্তু কেন বলবি তো?
আমি এখানে আর থাকব না, অন্যখানে আজই চলে যাব।
মাসুম খুব অবাক হয়ে বলল, কী পাগলামী করছিস?
আমি যে কখনো পাগলামী করিনি তা নিশ্চয় জানিস?
কিন্তু কেন যাবি বলবিতো? আমি কি এমন দোষ করেছি? যে জন্যে তুই আজ দশ বার দিন আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিসনি, এখন আবার চলে যেতে চাচ্ছিস?
তুই কোনো দোষ করিসনি। আমার তকদির আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে মাহবুবার কারণে তুই পালাতে চাচ্ছিস? তারপর তার দুটো হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, না বললে কিছুতেই যেতে দেব না।
মাহবুব বলল, ঠিক আছে বলছি, তবে তার আগে তোকে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব, কোনো দিন কাউকে বলবি না। মাহবুবাকে তো নই-ই।
করলাম।
হাত ছেড়ে বস, বলছি। তারপর আব্বা তাকে না জানিয়ে কি ভাবে লেখাপড়া করাচ্ছে এবং দুবছরের মধ্যে আলাউদ্দিন মীরের এক লাখ টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে কি হবে, সব কিছু খুলে বলে বলল, যেমন করে থোক এই সময়ের মধ্যে আমাকে এক লাখ টাকা যোগাড় করতেই হবে।
মাসুম বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু এখান থেকে চলে যাবি কেন?
এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারলি না? আরে বোকা, এখানে থাকলে মাহবুবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে। এখন আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আমার উচিত হবে না।