আলাউদ্দিন মীর বললেন, চল ঘরে গিয়ে বলছি। ঘরে এসে বললেন, সুলতান খাঁনের ছেলে মাহবুব। তার অসুখ তাই ছেলেকে বার হাজার টাকার জন্য পাঠিয়েছে।
রোশনী বিবি টাকার ব্যাপারটা জানেন, তাই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বললেন, টাকাটা দিয়ে এস. কথা আছে।
আলাউদ্দিন মীর টাকা নিয়ে মাহবুবের কাছে এসে দেওয়ার সময় বললেন, তোমার আব্বাকে বলো, এই বার হাজারই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই।
মাহবুব যে কথা আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, সে কথা জানার আগ্রহ চেপে রাখতে পারল না। বলল, আব্বা আপনার কাছে কিসের টাকা পেতেন?
তোমার আব্বা কি তোমাকে কিছুই বলেন নি?
জ্বি না।
আলাউদ্দিন মীর চিন্তা করলেন, ছেলে অমত করবে বলে হয়তো সুলতান খাঁন তাকে জানাইনি। সুযোগ যখন এসেছে তখন আমারই জানিয়ে দেওয়া উচিত। নচেৎ পরে এই ছেলে আমাকে দোষ দিতে পারে। বললেন, তোমাকে লেখাপড়া করাবার জন্য বড় পুকুরটা সাত বছরের জন্য এক লাখ টাকায় সাফকবলা রেখেছেন। এই সময়ের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিলে তোমাদের পুকুর তোমাদের থেকে যাবে। আর না দিতে পারলে সাত বছর পর আমাদের হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে মাহবুবের মনে হল, তাকে যেন কেউ সূউচ্চ পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। অনেক্ষণ মাথানিচু করে চুপ করে রইল। তখন তার একটা হাদিসের কথা মনে পড়ল, আল্লাহ যখন কোনো লোককে অপমানিত করতে চান, তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন। হাদিসটা মনে পড়তে আব্বার উপর প্রচন্ড অভিমান হল। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
আলাউদ্দিন মীর তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এতে তুমি এত চিন্তা করছ কেন? তোমার আব্বা তোমাকে উচ্চ শিক্ষিত করে মানুষ করার জন্য যা করেছেন, তা অত্যন্ত ভালো কাজই করেছেন। তার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। এই বছরই তো তুমি পাশ করে বেরোবে। এখনো দুবছর সময় আছে, এর মধ্যে তুমি রোজগার পাতি করে টাকাটা দিয়ে দিও। তা হলে তো কোনো সমস্যা নেই।
মাহবুব চোখ মুছে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসি চাচা। তারপর মাতালের মতো টলতে টলতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
আলাউদ্দিন মীরের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুঠে উঠে মিলিয়ে গেল। তারপর স্ত্রীর কাছে ফিরে এসে বললেন, বলো কি বলবে।
রোশনী বিবি বললেন, তুমি তো সুলতান খাঁনের পুকুর নেওয়ার তালে আছ। আর তোমার মেয়ে যে তার ছেলেকে ভালবাসে, তার কী হবে?
আলাউদ্দিন মীর চমকে উঠে বললেন, কি বাজে কথা বলছ?
বাজে কথা নয় সত্য। তারপর তাহেরা ও মাহবুবের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে। খুলে বলে বললেন, আমার কি মনে হয় জান, তাহেরা মাহবুবের জন্যই এতদিন বিয়েতে রাজি হয়নি।
স্ত্রীর কথা শুনে আলাউদ্দিন মীর অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটা অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
তোমার এসব বোঝার সময় কোথায়? সব সময় তো চিন্তা কর, কি করে সম্পত্তি বাড়াবে। এখন আমি একটা কথা বলি শোন, তোমার মুখেই খানেদের অনেক গুণাগুণ শুনেছি। মাহবুবের গুণাগুণও তুমি আমার কাছে অনেক করেছ। এখন তাকে জামাই করার ব্যবস্থা কর।
আলাউদ্দিন মীর হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তুমি দারুন কথা বলেছ। মাহবুবের মতো সোনার টুকরো ছেলের জন্য এক লাখ কেন, কয়েক লাখ খরচ করলেও পাওয়া যাবে না। আমি দুএক দিনের মধ্যে সুলতান খাঁনের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু সুলতান খাঁন কি আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে রাজি হবেন। হাজার হোক আমাদের পূর্ব পুরুষরা এক সময় তাদের প্রজা ছিল।
রোশনী বিবি বললেন, সে সব অনেক আগের কথা। তা ছাড়া তাহেরার কথাটা আমাদের চিন্তা করতে হবে না?
ঠিক আছে তাই হবে। এখন যাই পাশের গ্রামে একটু যেতে হবে। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বেরিয়ে গেলেন।
মাহবুব ফেরার পথে মনকে শক্ত করল। ভাবল, আব্বা আমাকে না জানিয়ে ভুল করলেও আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য করেছেন। এখন কিছু বলে তার মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত নিল, আব্বার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলাপ করবে না। আরো সিদ্ধান্ত নিল, পরীক্ষার পর যেমন করে তোক উপার্জন করে আলাউদ্দিন মীরের এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করতেই হবে। তারপর মনে মনে আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ পাক, তুমি আমাকে এই টাকা পরিশোধ করার তওফিক দিও।
ঘরে এসে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আব্বাকে টাকা নিয়ে আসার কথা ও আলাউদ্দিন মীর যা বলতে বলেছিলেন বলল। তারপর পাঁচশো টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, আমার সাড়ে এগার হাজার টাকা হলেই চলবে।
মরিয়ম খাতুন টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের লাগবে না, তুই নিয়ে যা। তোর অসুবিধা হলে কোথায় পাবি?
মাহবুবের শুধু কান্না পাচ্ছে। মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এল।
মাহবুব চৌদ্দ দিন বাড়িতে থেকে ঢাকা ফিরে এল। আসবার সময় মাকে বলে এল, আমি টাকা চেয়ে না পাঠালে, তোমরা পাঠিও না।
মাসুম মেসেই ছিল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করল, কিরে দুদিনের কথা বলে দুসপ্তাহ পার করে এলি যে?
মাহবুব আব্বার অসুখের কথা বলল।
একটা চিঠিও তো দিতে পারতিস। এদিকে তোর মাহবুবা প্রতিদিন এসে আমার উপর ঝাল ঝাড়ছেন। তুই তাকে না জানিয়ে গেলি, আর সেই রাগটা আমার উপর দেখাচ্ছেন। প্রেম ও স্বপ্ন/৪