তাহেরা মাহবুবকে আজও ভুলতে পারেনি। তাই সে যতবার বাড়ি এসেছে ততবারই চাকর রহিমকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। আসেনি বলে মনে আঘাত পেলেও তার প্রতি বিদ্বেষ জন্মায়নি বরং তার জন্যে আরো পাগল হয়ে উঠেছে। এবারে, তার আসার খবর পেয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল। মাহবুব আসেনি।
আলাউদ্দিন মীরের পূর্ব পূরুষদের ও তাদের বর্তমান অবস্থার কথা মাহবুব আব্বার কাছে শুনেছিল। আরো শুনেছিল, তাদের পারিবারিক পরিবেশ খুব নিচু শ্রেণীর। তাই কলেজে পড়ার সময় তাহেরা যেদিন তাকে ডেকে ভালবাসার কথা জানায় সেদিন মনের কথা না জানালেও পরে যখন চাকরের হাতে বার বার ডেকে পাঠিয়েছে তখন আব্বার কথা স্মরণ করে তার সঙ্গে দেখা করেনি। আজ তার বাবার কাছে টাকা চাইতে আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, তাহেরা কত দিন ডেকে পাঠিয়েছে, সে একদিনও যাইনি। আজ তার সঙ্গে দেখা হলে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তা হলে কি বলবে। এই সব ভাবতে ভাবতে আলাউদ্দিন মীরের কাঁচারী বাড়ির সামনে এসে চাকর রহিমকে দেখে জিজ্ঞেস করল, মীর চাচা ঘরে আছেন?
রহিম চোদ্দ পনের বছরের এতিম ছেলে। সাত আট বছর বয়সের সময় থেকে এদের বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। সে মাহবুবকে চিনে। তাকে দিয়েই তাহেরা মাহবুবকে ডেকে পাঠায়। বলল, দাঁড়ান দেখে আসি। তারপর বাড়ির ভিতর চলে গেল।
তাহেরা নাস্তা খেয়ে বারান্দায় এসে কুলি ফেলল। তারপরে রহিমকে দেখে বলল, কিরে কিছু বলবি নাকি?
রহিম বলল, আপা, আপনি যাকে ডেকে আনার জন্য আমাকে পাঠান, তিনি চাচার খোঁজ করছেন।
তাহেরা চমকে উঠে বলল, কি বললি? মাহবুব ভাই এসেছে?
হ্যাঁ আপা, আমি কাঁচারী ঘরের সামনে গরুর জন্য খড় কাটছিলাম। চাচা ঘরে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। চাচাকে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। সেকথা বললে যদি চলে যান, তাই একটু দাঁড়াতে বলে আপনার কাছে এলাম।
তাহেরা বলল, খুব ভালো করেছিস। যা ওকে কাঁচারী বাড়িতে বস, আমি আসছি। আর শোন, আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি উনি একটু পরে আসছেন।
জ্বি আচ্ছা বলে রহিম চলে গেল।
তাহেরা তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে সামান্য প্রসাধন করল। তারপর কাঁচারী বাড়িতে এসে মাহবুবকে সালাম দিয়ে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য, যাকে পাঁচ-ছ-বছর ধরে ডেকেও দেখা পাওয়া যায় নাই হঠাৎ তার আগমন? তা কেমন আছ?
এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারে মাহবুব চিন্তা করেছিল। তাই কুণ্ঠিত হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?
ভালো মন্দ জেনে কি হবে? আমার কথা কী তোমার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন?
তা হলে পাঁচ-ছ-বছর দেখা করনি কেন? ডেকে পাঠালেও আসনি কেন?
মাহবুব উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
আমার কথার উত্তর তুমি যে দিতে পারবে না, তা আমি জানি। তবু কয়েকটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। পাঁচ-ছ-বছর আগে একদিন এখানেই তোমাকে যে কথা বলেছিলাম, তার উত্তর শোনার জন্য আজও তোমার প্রত্যাশায় আছি। সেদিন তুমি বলেছিলে প্রেম ভালবাসা মনের ব্যাপার। যেদিন মন থেকে সাড়া পাব সেদিন। জানাব। আজও কী তোমার মনে সেই সাড়া জাগেনি?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে মাহবুব চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাহেরা বসে পড়ে মাহবুবের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে ভিজে গলায় বলল, তুমি বলতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনে আমার জায়গা কখনো হবে না। তোমার কথাই ঠিক প্রেম ভালবাসা কখনো জোর করে আদায় করা যায় না, ওটা মনের ব্যাপার। তবে একটা কথা মনে রেখ, বি. এ. পাশ করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছে; তোমার জন্য তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আর একটা কথাও মনে রেখ, তোমার মনে আমার জায়গা না হলেও আজীবন তুমি আমার মনি কোঠায় বিরাজ করবে। দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করুক। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।
তাহেরার মা রোশনী বিবি রহিম তাহেরাকে যা কিছু বলেছে, খাওয়ার ঘর থেকে সব শুনেছেন। তারপর মেয়ের কথা শুনে ও তাকে সাজ-গোজ করে কাঁচারী বাড়িতে যেতে দেখে ভাবলেন, কে এই মাহবুব? তাকে তাহেরা ডেকেই বা পাঠায় কেন? এখন আবার তার কাছে গেলই বা কেন? তা হলে কী একেই তাহেরা পছন্দ করে? আর সেই জন্যই কী নানা ছুতায় বিয়ে করতে রাজি হয়নি? ছেলেটা কে দেখার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে কাঁচারী বাড়ির পূর্ব পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের সব কিছু দেখছিলেন ও শুনছিলেন। মেয়েকে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে দেখে তিনিও চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আলাউদ্দিন মীর বাইরে থেকে এসে কাঁচারী বাড়িতে মাহবুবকে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গেলেন।
মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আলাউদ্দিন মীর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, দাঁড়ালে কেন বস। তারপর নিজেও বসে বললেন, কয়েক দিন আগে তোমার আব্বার অসুখের কথা শুনেছিলাম। যাই যাই করেও কাজের চাপে যেতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে এখন ভালোর দিকে। বার হাজার টাকার জন্য আব্বা আমাকে পাঠালেন।
ঠিক আছে, তুমি বস, আমি আসছি। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।
রোশনী বিবি বারান্দায় ছিলেন। স্বামী কাছে এলে বললেন, কে ছেলেটা? চেনা চেনা মনে হলেও চিনতে পারছি না।