সে কথা জানতে হলে আসুন আমার সঙ্গে। তারপর রুমে এসে বসতে বলে বলল, কেমন আছেন আগে বলুন।
ভালো। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো, তবে বন্ধু বিহনে, ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছি না।
তা কেন? একা একা পড়াশোনা তো ভালো হওয়ার কথা।
আপনার কাছে ভালো হলেও আমি একা একা পড়তে পারি না।
প্রাইমারীতে পড়ার সময় একজন শিক্ষকের কাছে শুনে ছিলাম।
একে গুন গুন, দুয়ে ঠিক।
তিনে গন্ড গোল, চারে হাট।
মাহবুবা হেসে উঠে বলল, আরে ভাই, ওটা তো প্রাইমারী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নয়? থাক আপনার বন্ধুর নিখোঁজের খবর বলুন।
সেতো চার পাঁচ দিন আগে বাড়ি গেছে, কেন আপনাকে জানাইনি?
জানালে কি আর খোঁজ নিতে আসতাম? কদিন থাকবে কিছু বলে গেছে?
বলে তো গেল দুদিন থাকবে। চার পাঁচ দিন হয়ে গেল এল না। মনে হয় আজ কালের মধ্যে চলে আসবে।
ঠিক আছে চলি তা হলে?
সে কি? কিছু না খাইয়ে ছাড়ছি না। বসুন চা করি, ঘরে বিস্কুট চানাচুর আছে।
চা খেয়ে মাহবুবা বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
.
মাহবুব বাড়িতে আসার পাঁচ দিন পর সুলতান খাঁনের ভীষণ জ্বর হল। মাহবুব ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। কিন্তু কোনো কাজ হল না। দিনে রাতে চার পাঁচবার জ্বর ১০৪ ডিগ্রী উঠে। মাথায় পানি দিলে, ঔষুধ খাওয়ালে কমে। ওষুধের এ্যাকসান কেটে গেলে আবার উঠে।
তিন চার দিনের মধ্যে কোনো উন্নতি না হতে মাহবুব টাউন থেকে বড় ডক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে লাগল। আট দশ দিন পর জ্বর ভাল হল। আরো দুদিন পর। মাহবুব মায়ের সামনে আব্বাকে বলল, ডাক্তার বললেন, আপনি কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তাই বলছিলাম এবার আমি ঢাকা যেতে চাই, আমার পড়া শোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। এমনি অসুখ হয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
সুলতান খাঁন বললেন, হাঁ বাবা, তুমি কালকেই রওয়ানা দাও। আল্লাহ চাহেতো আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাব।
মাহবুব বলল, আমার হাজার বার টাকা লাগবে।
সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কি দরকার?
আমার টাইফয়েড হয়েছিল। বন্ধু মাসুম, যে গত বছর বেড়াতে এসেছিল, আমরা তো মেসে একরুমে থাকি। প্রথমে সে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করায়। তিন দিনের দিন জ্বরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ডাক্তার মেডিকেলে নিতে বলেন। মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার আগে মাহবুবা নামে আমাদের একটা জানাশোনা মেয়ে তাদের গাড়িতে করে ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। সেখানে প্রায় পনের দিন ছিলাম। দশ হাজার টাকা বিল। হয়েছিল। আমার বা মাসুমের কাছে অত টাকা ছিল না। মাহবুবা দিয়েছে তাকে দিতে হবে।
সুলতান খাঁন বললেন, ঠিক আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।
একটা মেয়ে এত টাকা দিয়েছে শুনে মরিয়ম খাতুনের মনে সন্দেহ হল। ছেলেকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একটা মেয়ে শুধু শুধু তোর জন্য এতকিছু করল কেন?
মাহবুব মায়ের কথার উত্তর এড়াবার জন্য বলল, জান আম্মা, মাসুম আর মাহবুবা না থাকলে হয় তো এবার মারা যেতাম। ওদের দুজনের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।
মরিয়ম খাতুন বললেন, মাহবুবা বুঝি খুব বড় লোকের মেয়ে?
বড় লোকের মানে, ওর বাবা ভীষণ বড়লোক। বাংলাদেশের যে কয়েকজন বড় লোক আছেন, তাদের মধ্যে উনিও একজন।
মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু সে তোর জন্য অত কিছু করল কেন বলবি তো?
মাহবুব কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
কিরে বলছিস না কেন?
মাহবুব আমতা আমতা করে বলল, মেয়েটাও ভার্সিটিতে পড়ে। চেনা পরিচয় ছিল। আমার অসুখ হয়েছে জেনে করেছে।
মরিয়ম খাতুন বুঝতে পারলেন, মেয়েটা হয়তো মাহবুবকে পছন্দ করে। বললেন, আল্লাহ মেয়েটার ভালো করুক, তাকে সুখী করুক, তার মনের নেক কামনা পূরণ করুক।
মাহবুব মনে মনে বলল, আমিন।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে শুধু মাহবুবের লেখাপড়ার খরচের জন্য টাকা নেন। এবারে টাকা আনার আগেই জ্বরে পড়েছেন। এক সময় ছেলেকে ডেকে বললেন, তুমি আলাউদ্দিন মীরের কাছে যাও। তাকে বলবে আব্বা বার হাজার টাকা দিতে বলেছে।
মাহবুব কখনো আব্বার কথার উপর কথা বলেনি। তাই বেশ অবাক হলেও আলাউদ্দিন মীরের কাছে কেন টাকা চাইতে বলছেন, জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সামলে নিল। বলল ঠিক আছে, এক্ষুণী যাচ্ছি।
সুলতান খাঁন বললেন, তাকে বলবে আমি অসুস্থ তাই তোমাকে পাঠিয়েছি।
জ্বি বলব বলে মাহবুব বেরিয়ে গেল।
আলাউদ্দিন মীর প্রথম জীবনে একজন সাধারণ গৃহস্থ ছিলেন। নিজে সামান্য লেখাপড়া জানেন। অর্থাভাবে পাঁচ ছেলেকেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়াতে পারেন নি। তা ছাড়া ছেলেগুলোর মোটা বুদ্ধি। কিন্তু মেয়ে তাহেরা যেমন চালাক চতুর তেমনি বুদ্ধিমান। তাই সব ভাইয়েরা তাকে যেমন খুব ভালবাসে তেমনি তার আব্দারও পূরণ করে। আলাউদ্দিন মীরও মেয়েকে অত্যন্ত ভালবাসেন। মেয়ের পড়া শোনার ঝোঁক দেখে পড়া বন্ধ করেননি। দূরে কলেজ বলে যাতায়াতের জন্য বাঁধা রিক্সার ব্যবস্থা করেছেন। তাহেরা গত বছর বি.এ. পাস করেছে। এস.এস.সি. করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। আলাউদ্দিন মীরও চেয়েছিলেন বিয়ে দিতে; কিন্তু তাহেরা রাজি হয়নি। বলেছে এম.এ.পাস না করা পর্যন্ত তোমরা আমার বিয়ের কথা চিন্তা করবে না। আলাউদ্দিন মীর আদরের মেয়ের কথার প্রতিবাদ করেনি।