ধানমণ্ডীর একটা ক্লিনিকে মাহবুব আজ দশ দিন আছে। এখন ভালোর দিকে। ক্লিনিকে না আনলে হয়তো মাহবুব মারাই যেত। দুদিন আশঙ্কাজনক অবস্থায় কেটেছে। সব সময় মাথায় বরফ দেওয়ার পর জ্বর কমে এবং সেই সাথে জ্ঞানও ফিরে। তার টাইফয়েড হয়েছে। এখনো জ্বর ১০২ এর মধ্যে ওঠা নামা করছে। জ্ঞান ফেরার পর মাহবুবাকে দেখে মাহবুব যেমন খুব অবাক হয়েছিল তেমনি আনন্দিতও হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। শুধু তার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়েছে। পরে মাসুমের কাছে সব কিছু শুনে আরো বেশি আনন্দিত হয়েছে; কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করে নি। তারপর সকাল-বিকাল এসে সেবা যত্ন করতে দেখে একদিন বলল, আপনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন এবং এখনো করছেন, তা আজকাল কোন আপনজনও করে না। আপনার ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না।
মাহবুবা বলল, আপনি বুঝি এই সব চিন্তা করছেন? আর আমি চিন্তা করছি, সেদিন আপনি আমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রেখেছেন। সেই ঋণ এই সামান্য সেবাযত্নে কি আর শোধ হয়েছে? তা ছাড়া আমি আর আপনার কতটুকু করেছি, মাসুম সাহেব যা করেছেন এবং করছেন, সে তুলনায় আমারটা নগন্য। ঋণী হলে তার কাছে হয়েছেন?
হ্যাঁ, মাসুমের ঋণও আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। আপনারা দুজনে না থাকলে অনেক আগেই হয়তো কবরে চলে যেতাম।
মাহবুবা আপেল ও কমলা ছাড়িয়ে সামনে দিয়ে বলল, এখন ঋনের কথা রেখে এগুলো খান। তারপর খাইয়ে দিতে লাগল।
মাহবুব খেতে খেতে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
মাহবুব সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার জন্য এতকিছু করছেন কেন বলবেন?
একটু আগে বললাম না, ঋণ শোধ করছি। বিশ্বাস হয় না।
কেন?
সেদিন না খেয়ে আপনাদের বাসা থেকে চলে আসায় এমন কিছু ঋণী হন নি, যে জন্য এতকিছু করার প্রয়োজন আছে। নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে।
তাও থাকতে পারে।
সেটাই জানতে চাই।
ততক্ষণে খাওয়ান শেষ হয়েছে। প্লেটটা রেখে মাহবুবা নিজের রুমালে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, আমার তো মনে হয় আপনি জানেন। তবু জানতে চাচ্ছেন কেন?
সিওর হওয়ার জন্য।
যদি বলি যা জেনেছেন, তা সত্য?
মাহবুব অনেক্ষণ চুপ করে রইল।
কিছু বলছেন না যে?
কি বলব বলুন, আমার খুব ভয় হচ্ছে।
আপনি পুরুষ, ভয় পাবেন কেন? বরং আমারই ভয় পাওয়ার কথা।
আপনার ভয় লাগছে না?
একটুও না।
আপনি একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে।
আর আপনি বুঝি গোবেচারা?
তা ছাড়া আর কি?
আপনি যে আমার থেকে ডেঞ্জারেস, তা অনেক আগেই জানি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। জানেন, প্রায় বছর খানেক আগে যেদিন সুটিং-এ আপনি ফাক্ট হলেন, সেদিন আমিও সেখানে ছিলাম। আপনাকে দেখেই ভালবেসে ফেলি। ঐদিন আপনার সঙ্গে পরিচয় করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। সেবা মেয়েদের সাঁতার প্রতিযোগীতায় আমিও অংশ নিই। কিন্তু কোনো পদক পাইনি। তারপর ছেলেদের প্রতিযোগীতা দেখতে গিয়ে আপনাকে পাই। তবে তার আগে দুএকবার ভার্সিটিতে দেখেছি। আলাপ করার জন্য আপনার পিছুও নিয়েছি। কিন্তু কিভাবে একজন অচেনা ছেলের সঙ্গে আলাপ শুরু করব ভেবে ঠিক করতে না পেরে ফিরে এসেছি।
এমন সময় মাসুমকে আসতে দেখে মাহবুবা চুপ করে গেল।
মাসুম কাছে এসে সালাম দিয়ে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে আজ কেমন আছিস?
মাহাবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর তার হাতে টিফিন বাক্স দেখে বলল, ওটা এখন রেখে দে, পরে খাব।
মাসুম ঘড়ি দেখে বলল, সে কিরে, বেলা দুটো বাজে খিদে পায়নি?
পেয়েছিল। তারপর মাহবুবাকে দেখিয়ে বলল, উনি একটু আগে কি সব খাওয়ালেন।
মাসুম মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কী আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?
কেন বলুন তো?
আমার একটু কাজ আছে। এক্ষুণী যেতে হবে। ওকে খাইয়ে যাব মনে করেছিলাম; কিন্তু ওতো এখন খাবেনা বলছে।
ঠিক আছে আপনি যান, আমি খাইয়ে তারপর যাব।
মাসুম সালাম বিনিময় করে যাওয়ার সময় মাহবুবকে বলল, যাই দোস্ত, রাতে তো আসছি। তারপর চলে গেল।
মাসুম চলে যাওয়ার পর মাহবুব বলল, আপনার খিদে পায়নি?
পেলেও মেয়েদের সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এবার আপনার মা বাবার কথা বলুন।
জানতে খুব ইচ্ছা করছে বুঝি?
না হলে বললাম কেন?
ওঁরা গ্রামের সহজ সরল মানুষ, বলার মতো কিছু নেই।
তবু বলুন শুনব।
মায়ের কথা আর কি বলব, মাতো মাই-ই। আর বাবাও তাই। তবে বাবার কিছু এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন আছে। যেমন তিনি একজন দক্ষ সাঁতারু ও লাঠিয়াল। অবশ্য কোনো দিন প্রতিযোগীতায় যোগ দেননি। আমার দাদা এবং তার বাবাও তাই ছিলেন।
মাহবুবা বলে উঠল,তাই বোধ হয় আপনিও দক্ষ সাতারু?
হ্যাঁ, বাবার কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছি। বাবাতো এখনো প্রতিদিন গোসল করার সময় অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন।
আপনাদের বাড়ির কাছে নিশ্চয় নদী আছে?
আমাদের গ্রাম থেকে নদী অনেক দূরে। তবে আমাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। গ্রামের লোকের পানির কষ্ট দূর করার জন্য আমার পরদাদা, মানে দাদার বাবা পুকুরটা কাটিয়েছিলেন। তার চার পাশে চারটে পাকা ঘাটও করে দিয়েছিলেন। আর চারদিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাগানের ফল ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে আমাদের প্রচুর আয় হয়। পুকুরটা এতবড় যে, গ্রামের ছেলে, বুড়ো কেউ পারাপার হওয়ার সাহস পায় না। তাই আমি, বুবু ও আব্বা যখন সাঁতার কেটে পুকুরের এপার ওপার হতাম তখন গ্রামের ছোট বড় সব মেয়ে পুরুষ চারপাশের পাড়ে এসে ভীড় করতো।