আসমা কাহহার সাহবেকে দেখেই চিঠিসহ হাতটা জামার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বলল, আমি হালিম সাহেবের বাসার কাজের বুয়ার মেয়ে।
কাহহার সাহেব বললেন, এখানে কেন এসেছ? তারপর হঠাৎ তার একটা হাত জামার ভেতরে দেখে বললেন, তোমার হাতে কি আছে দেখি?
আসমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
কাহহার সাহেবের কেমন যেন সন্দেহ হল। বললেন, হাতে কি আছে দেখাও।
তবু আসমা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কাহহার সাহেবের সন্দেহটা দৃঢ় হল। এগিয়ে এসে জামার ভেতর থেকে হাতটা বের করতে সাদা খাম দেখে অবাক হয়ে বললেন, এটা কাকে দিতে যাচ্ছিলে? তাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে খামটা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, এটা নিয়ে তোমাকে কে পাঠিয়েছে?
আসমা কেঁদে ফেলল।
কাহহার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? তোমার কোনো ভয় নেই। এটা দিতে কে পাঠিয়েছে? আর কাকে দিতে বলেছে বলতো।
আসমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপা রাজশাহী যাওয়ার আগের দিন ওটা আমাকে দিয়ে বলল, ও বাড়ির টোপর ভাই গ্রামের বাড়িতে গেছে, ফিরে এলে দিস। কাল টোপর ভাইকে দেখলাম, তাই দিতে এসেছি।
কাহহার সাহেব বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও, আমি টোপরকে এটা দিয়ে দিব। তারপর রুমে এসে চিঠি পড়ে খুব রেগে গেলেন।
নাস্তা খাওয়ার সময় শাফিয়া বেগম স্বামীর গম্ভীর মুখ দেখে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তাই নাস্তা সামান্য খেয়ে চা দিতে বলায় কিছু বললেন না।
কাহহার সাহেব অফিসে চলে গেলেন।
দুপুরেও ভাত খাওয়ার সময় সামান্য খেয়ে উঠে যেতে দেখে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?
কাহহার সাহেব কোনো কথা না বলে হাত মুখ ধুয়ে চলে গেলেন।
কাহহার সাহেবের সিগারেট খাওয়ার নেশা না থাকলেও কিছু খাওয়ার পর পান খান।
শাফিয়া বেগম পান সেজে স্বামীর রুমে এসে দেওয়ার সময় বললেন, শরীর খারাপ কিনা কিছু বললে না যে?
কাহহার সাহেব বালিসের তলা থেকে চিঠিটা বার করে স্ত্রীর হাত দিয়ে বললেন, হালিম সাহেবের বাসার কাজের মেয়ে টোপরকে দিতে এসেছিল।
শাফিয়া বেগম চিঠি পড়ে মনে মনে খুশি হলেন। কারণ উনি চান না প্রতিবেশির সঙ্গে শত্রুরা রাখতে। ওদের বিয়ের মাধ্যমে যদি শত্রুতার অবসান হয়, তা হলে ভালই হয়। সেই জন্য প্রথম যখন ওদের মেলামেশা নিয়ে স্বামী ছেলেকে রাগারাগি করে তখন তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, তুই এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সময় মতো তোর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাব। কিন্তু ওরা যে এত শিঘ্রী বিয়ে করবে এটা মেনে নিতে পারলেন না। আতঙ্কিত স্বরে বললেন, কি সর্বনাশ, ওরা এতদূর এগিয়েছে?
কাহহার সাহেব গম্ভির স্বরে বললেন, টোপর যে এরকম হবে তা ভাবতেই পারছি না। তুমি আস্কারা দিয়ে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছ।
শাফিয়া বেগম একটু রাগের সঙ্গে বললেন, তা না হয় স্বীকার করলাম; কিন্তু তুমি তো তার বাবা, আমাকে শুধু দোষ দিচ্ছ কেন?
দোষ দিচ্ছি এই জন্যে যে, ছেলে-মেয়েদেরকে লালন-পালন করার দায়িত্ব মায়ের। মা যেভাবে তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে মানুষ করবে, তারা সেই ভাবে মানুষ হবে।
শাফিয়া বেগম বললেন, আমি আমার দায়িত্ব যথাসাধ্য পালন করেছি। এখন সে বড় হয়েছে, ভার্সিটিতে পড়ছে, বাইরে কি করছে না করছে তা জানব কি করে?
কাহহার সাহেব বললেন, ওসব কথা রেখে এখন কি করা যায় তাই বল। আমি ভাবছি, চিঠিটা হালিম সাহেবকে দিয়ে এর একটা বিহিত করতে।
সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। উনি হয়তো বলবেন, আপনারা আপনাদের ছেলেকে সামলান। আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে নষ্ট করেছে। শেষ-মেস ঝগড়ার সৃষ্টি হবে।
তা বলতে পারেন, তবু আমি চিঠিটা দিতে চাই। বুঝতে পারছ না কেন, চিঠি তো টোপর দেয় নি, দিয়েছে তার মেয়ে। চিঠি পড়ে তারা তাদের মেয়ের ব্যাপারটা জানতে পারবেন।
ঠিক আছে, তা হলে দাও। তবে তুমিও একটা কাগজে লিখে দাও, কিভাবে চিঠিটা পেলে। আরো লিখে দাও, আমরা আমাদের ছেলেকে সামলাব, আপনারা আপনাদের মেয়েকে সামলাবেন। নচেৎ পরিণতির জন্য আপনারাই দায়ী হবেন।
তুমি খুব ভালো কথা বলেছ বলে কাহহার সাহেব একটা কাগজে কথাগুলো লিখে নিজের নামও লিখলেন। তারপর খামের ভিতর দুটো চিঠি ভরে কাজের মেয়ে দুলারীকে ডেকে বললেন, এটা টিকলীর বাঘা হালিম সাহেবকে দিয়ে এস। তাকে যদি না পাও, তার স্ত্রীর হাতে দিবে। খবরদার, অন্য কাউকে দেবে না।
দুলারী যখন চিঠিটা দিতে এল তখন হালিম সাহেব সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। দুলারী খামটা তার হাতে দিয়ে বলল, আমার সাহেব এটা দিয়েছেন।
হালিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন বাসায় কাজ কর?
দুলারী বলল, টোপরদের বাসায়।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
দুলারী ফিরে এলে কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিরে হালিম সাহেবের হাতে দিয়েছিস তো?
জ্বী।
দুলারী চলে যাওয়ার পর শাফিয়া বেগম বললেন, মেয়েটা তো কয়েক দিনের মধ্যে ডাকে চিঠি দেবে। তখন যদি টোপর এই চিঠির কথা জানতে পেরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কি বলব?
টোপর তার চিঠি যাতে না পায়, সে ব্যবস্থা করব
শাফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না।
কাহহার সাহেব ঐদিন ডাকঘরে গিয়ে পিয়নকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, টোপরের নামে কোনো চিঠি পত্র এলে তাকে না দিয়ে আমাকে দেবেন।