টিকলী কান্না মুখে হাসি দিয়ে বলল, তুইও এবার হাস, তোর হাসি মুখ দেখলে মন দিয়ে পড়তে পারব।
টোপর হেসে উঠে বলল, আমরা আগের মতো গোপনে দেখা করব, আর বাসায় এমন ভাব দেখাব, যেন সবাই মনে করে আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
টিকলী বলল, বেশ তাই হবে।
৩. টোপর অনার্স পাশ
পরের বছর টোপর অনার্স পাশ করার পর কাহহার সাহেব বললেন, ভার্সিটি থেকে মাস্টার্সটা কমপ্লীট কর, তারপর ফরেনে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।
টোপর বলল, তুমি তো বলেছিলে অনার্স নেওয়ার পর পাঠাবে?
তা বলেছিলাম, এখন চিন্তা করে দেখলাম, মাষ্টার্স করে যাওয়াই ভাল।
টোপর খুব অসন্তুষ্ট হলেও প্রতিবাদ করল না। ভাবল, ভালই হল, এর মধ্যে টিকলীকে বিয়ে করে ফেলবে।
ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একদিন টিকলীকে ঘটনাটা বলে বলল, মাষ্টার্স নিতে এক বছরের কোর্স হলেও সেশন জটের কারণে দুই আড়াই বছর লেগে যাবে। তারপর ফরেনে গিয়ে তোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে আরো দুতিন বছর লেগে যাবে। এতদিন তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। তার চেয়ে আমরা গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেলি চল। ব্যাপারটা গোপন রাখব। কোথাও কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার নাম করে হানিমুনের কাজটা সেরে ফেলব।
টিকলী এইচ, এস, সিতে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেষ্ট দিয়েছিল। ঢাকায় না টিকলেও রাজশাহীতে টিকেছে। সেও টোপরকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু টোপর যেভাবে চাইছে, সেভাবে নয়। তাই কি বলবে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল।
কিরে কিছু বলছিস না কেন?
এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ছেলেরা চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও মেয়েরা পারে। আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দে।
এতে ভাববার কি আছে?
তোকে তো আসল কথাটাই বলা হয় নি। আমি রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেস্টে টিকে গেছি। কয়েকদিনের মধ্যে ভর্তি হব। আমার বড় খালা খালু ওখানে থাকেন। তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করব।
তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। যখনই মন চাইবে তখনই তোর কাছে যেতে পারব। এখন বল, কবে কাজি অফিসে যাবি?
কাজি অফিসের কাজটা রাজশাহীতে হবে। আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাব।
কথাটা ঠিকই বলেছিস, ওখানে করলে কোনো হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে পারব।
টিকলী হেসে উঠে বলল, তুই তো দেখছি মধুচন্দ্রিমার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিস।
আর তুই বুঝি হসনি? ঠিক আছে, বিয়ের রাতে আমি একাই মধুচন্দ্রিমা যাপন করব।
টিকলী হেসে উঠে বলল, একা একা আবার মধুচন্দ্রিমা রাত যাপন করা যায় বুঝি?
টোপর বলল, যায় কিনা যায়, সেই রাতে দেখিয়ে দেব।
টিকলী হাসতে হাসতেই বলল, তাই দেখাস, কিন্তু বাছাধন, আমি তো বড় খালাদের বাসায় থাকব। হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবি কি করে?
তোর খালাদের বাসা থাকতে হোটেলে থাকব কোন দুঃখে। কাজি অফিসে বিয়ে করে এসে খালা-খালুকে সালাম করে দোওয়া নিতে যাব। দেখবি তখন তারাই বাসাতে মধুচন্দ্রিমা যাপনের ব্যবস্থা করে দেবেন।
আর যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেন?
তা হয় তো দিতে পারেন; তবে আমার মনে হয় তা করবেন না। হাজার হোক। ভাগ্নি জামাই তো। তারপর বলল, আগে সেই সময় আসুক তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
টিকলী বলল, ঠিক আছে, এমন বাসায় ফিরি চল।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এ্যাডমিশান নিয়ে টিকলী বড় খালাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। আসার আগে অনেক চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কারণ সে তার মাকে নিয়ে দেশের বাড়ি মনোহরদি গিয়েছিল। তাই আসার আগের দিন একটা চিঠি লিখল
টোপর,
প্রথমে আমার সালাম ও ভালবাসা নিবি। পরে জানাই যে, তোর সাথে দেখা না করে চলে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই আমাদের বুয়ার মেয়ে আসমার হাতে এই চিঠি দিলাম। চিঠি পেয়ে তুইও যে খুব কষ্ট পাবি, তা জানি। আমি কয়েক দিনের মধ্যে তোকে চিঠি দেব। তাতে ঠিকানা থাকবে। চিঠি পেয়ে অতি অবশ্যই আসবি। আর বিয়ের ব্যাপারে যদি প্রস্তুতি নিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়, তা হলে আমার চিঠি পাওয়া মাত্র একদিনের জন্য হলেও দেখা দিয়ে আসবি। তারপর তোর সময় সুযোগ মতো মধুচন্দ্রিমা যাপন করার জন্য আসবি। আর বেশি কিছু লিখতে পারছি না, শুধু কান্না পাচ্ছে। তাই এখানেই শেষ করছি।
–তোর টিকলী
চিঠিটা একটা সাদা খামে ভরে গাম দিয়ে মুখ এঁটে দিল। তারপর আসমাকে ডেকে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা ও বাড়ীর টোপরকে দিবি। সে দেশের বাড়ি গেছে। ফিরে এলে গোপনে দিবি। আর শোন, এখন এটা তোর সুটকেসে রেখে দে। খবরদার, কেউ যেন না জানে। তোর মাও যেন জানতে না পারে।
স্বামী পরিত্যাক্তা আনোয়ারা এক বছরের আসমাকে নিয়ে এ বাড়িতে কাজ করছে। আসমার বয়স এখন প্রায় দশ বছর। বেশ চালাক চতুর মেয়ে। টিকলী তাকে কোরান ও নামাজ পড়তে শিখিয়েছে। বাংলা-ইংরেজীও এখন পড়ায়। তাই আসমা টিকলীর খুব বাধ্য। এখন তার কথা শুনে বলল, ঠিক আছে আপা, চিঠির কথা কেউ জানবে না।
টিকলী রাজশাহী চলে যাওয়ার তিন দিন পর টোপর ফিরল। পরের দিন আসমা জানতে পেরে চিঠিটা দিতে যাওয়ার সময় টোপরদের গেটের ভিতরে ঢুকে কাহহার সাহেবের সামনে পড়ে গেল। কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?