টিকলী রক্ষণশীল ফ্যামিলীর মেয়ে হয়েও টোপরের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য মা-বাবার সঙ্গে অনেক সময় মিথ্যা বলে। আলি বোনের সব কিছু জানলেও সবার সামনে কিছু বলে না। কারণ সে যে টিকলীর বান্ধবী জিনিয়াকে ভালবাসে, সে কথা টিকলী জানে। তাই একা পেলে বলে, তুই যে জন্যে মা-বাবাকে মিথ্যা কথা বলিস, তা আমি জানি। তখন টিকলী গাল ফুলিয়ে বলে, জান তো কি হয়েছে? আমিও তোমার প্রেম কাহিনী জানি। তুমি মা-বাবাকে আমার কথা বলে দিলে, আমিও তোমার কথা বলে দেব। আলি জানে, মা-বাবা টিকলীর ব্যাপারটা নিয়ে এমনিই রেগে আছে। তারপর যদি তার ব্যাপারটা জেনে যায়। তা হলে কি ঘটবে ভেবে টিকলীর কথা শুনে চুপ করে যায়।
টিকলী কয়েক দিন চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে আজও কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে আসতে দেখে সালাম দিয়ে পথ আগলে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
টোপর ও সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের চোখে পানি এসে গেল।
প্রথমে টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, এই কয়েক দিন তুই আমাকে না দেখে থাকতে পারলি? জানিস, আমি শুধু কেঁদেছি। একটুও পড়াতে মন বসাতে পারিনি।
টিকলী যেদিন প্রথম সালাম দেয়, সেদিন টোপর জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে আজ সালাম দিলি যে?
টিকলী বলেছিল, কাল আব্বা একটা হাদিস পড়ে শোনালেন, মুসলমানদের পরস্পরে সাক্ষাত হইলে একজন অন্যজনকে বলিবে, আসোলামু আলাইকুম (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা সুন্নত। কেহ সালাম দিলে তদুত্তরে বলিবে ওয়াআলাইকুম আসোলাম (তোমাদের উপর ও শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা ওয়াজিব। সালাম সাম্য শিক্ষার অন্যতম নিদর্শন। সালাম আদান প্রদানের নিয়ম। হল, ছোটরা সালাম দিবে বড়দের, আরোহী সালাম দিবে উপবিষ্টকে, যানবাহনের আরোহী সালাম দিবে পথি-পার্শ্বস্থ লোককে। কোনো অসুমলিম কোনো মুসলিমকে প্রথমে সালাম দ্বারা সম্ভাষণ করিলে তাহার উত্তরে বলিবে হাদা কাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে হেদায়েৎ দান করুন)। রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রথমে যে ব্যক্তি সালাম দেয়। মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই উত্তম। [বর্ণনায় : হযরত আবু ওসামাহ (রাঃ)-তিরমিজী, আবু দাউদ।]
টিকলী থেমে যেতে টোপর বলল, তোর বাবা তোদেরকে বেশ ধর্মীয় শিক্ষা দেন, আর আমার বাবা শুধু টাকা রোজগারের চিন্তায় সব সময় ব্যস্ত থাকেন।
আমি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বই কিছু কিছু দেব, পড়িস। তা হলে ধর্মীয় জ্ঞান পাওয়ার সাথে সাথে সে সর্ব মেনে চলারও প্রেরণা পাবি।
এখন ওসব পড়ার সময় কোথায়? ক্লাশের পড়া করতেই সময় কুলোয় না।
কেন, যখন অবসর সময়ে ঘোরাঘুরি করিস, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিস তখন পড়বি? আমিও তাই করি।
ঠিক আছে দিস তা হলে, পড়ব।
সেদিন টিকলীর উপর রাগ করে চলে এসে এই কয়েকদিন সেও মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তার কথা শুনে চোখ মুছে বলল, রাগের মাথায় সেদিন তোর মনে ব্যথা দিয়ে আমিও কম ব্যথা পাইনি। বল, মাফ করে দিয়েছিস?
টিকলী মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুই একা অন্যায় করিসনি, তোর কথা না শুনে আমিও করেছি। তা হলে আমাকেও তুই মাফ করে দে।
টোপর বলল, ঠিক আছে চল, যেতে যেতে কথা বলি। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আজ আর কলেজে গিয়ে দরকার নেই, কোথাও গিয়ে বসি চল। তোর সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে।
টিকলী বলল, আমার আপত্তি নেই। কোথায় যাবি বল দেখি?
টোপর একটু চিন্তা করে বলল, ওসমানী উদ্যানে। এ সময়ে ওখানে তেমন ভীড় থাকে না।
টিকলী বলল, বেশ তাই চল।
ওরা একটা চলন্ত স্কুটার থামিয়ে উঠে বসে যেতে বলল।
ওসমানী উদ্যানে এসে একটা গাছের তলায় বসে দুজন দুজনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এক সময় টিকলী বলল, কি জরুরী কথা বলবি বলে নিয়ে এলি বলবি না?
টোপর বলল, ভেবে দেখলাম, তোর কথাই ঠিক। বাবা বলছিলেন অনার্সটা নেওয়ার পর ফরেনে পাঠাবেন। যাওয়ার আগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব কি বলিস?
কথাটা শুনে টিকলী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
টোপর অধৈর্য গলায় বলল, কিরে চুপ করে আছিস যে?
টিকলী ম্লান মুখে বলল, ফরেনে গেলে তুই আমাকে ভুলে যাবি। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
টোপর তার হাত সরিয়ে দিয়ে চিবুক ধরে বলল, তোকে ভুলে যাব একথা ভাবতে পারলি? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতো, অবিশ্বাসের কিছু দেখতে পাস কি না?
তুই যে আমাকে কত ভালবাসিস তা জানি; ফরেনের ফ্রি মিক্সিং-এর কথা ভেবে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অতদিন তোকে না দেখে থাকতে পারব না। তুইও কি পারবি?
না পারলেও তোর জন্যে আমাকে পারতেই হবে। এখানে থাকলে আমাদেরকে দুই ফ্যামিলীর কেউ মেনে নেবে না। বরং শত্রুতা আরো বাড়বে। তাই ভেবেছি, ফরেনে গিয়ে পড়া শোনার সাথে সাথে চাকরিও করব। আর যেমন করে হোক গ্রীন কার্ড নেওয়ার চেষ্টা করব। গ্রীন কার্ড পেয়ে গেলে স্ত্রীকে মানে তোকে নিয়ে চলে যাব। তারপর বলল, কিরে প্ল্যানটা মনে ধরেছে?
ধরেছে, তবে আল্লাহ কতটা সাকসেসফুল করাবেন, তা তিনিই জানেন?
তা হলে এবার একটু হাসতো দেখি, এই কয়েক দিন তোর হাসি মুখ না দেখে আমিও পড়াতে একদম মন দিতে পারিনি।