টিকলীর ভাই আলির ফুলের খুব সখ। সেই জন্যে বাসার পশ্চিম পাশে একটা ফুলের বাগান করেছে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নার্সারী থেকে নানান ধরনের ফুলের গাছ কিনে এনে লাগিয়েছে। জুঁই, চামেলী, বকুল, জবা, নিশিপদ্ম, রজনিগন্ধা, গোলাপ ও জিনিয়া এবং আরো অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বাবাকে বলে একজন মালীও রেখেছে। নিজেও এই সব গাছের পিছনে অনেক পরিশ্রম করে। স্কুল জীবন পর্যন্ত টিকলীর সঙ্গে আলির মোটেই পড়ত না। আলি টিকলীর দুবছরের বড়। তাই তার উপর গার্জেনী ফলাত। টিকলী তা মোটেই সহ্য করতে পারত না। সামান্য একটা কিছু নিয়ে সব সময় টক-ঝক লেগেই থাকত। তুই তোকারী করত। কলেজে ঢোকার পরে টিকলী তুমি করে বললেও টক-ঝক লাগে। কেউ কারো কথা একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ফুল বাগান করা নিয়ে দুজনের খুব ভাব। টিকলীও ফুল খুব ভালবাসে। পড়তে পড়তে যখন ভালো লাগে না অথবা টোপরের সাথে কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হয় তখন ঘন্টার পর ঘন্টা ফুল বাগানে বেড়ায়, বসে থাকে। ফুলের উপর আদরের হাত বুলোতে বুলোতে তাদের সঙ্গে কথা বলে।
আজ নিউ মার্কেট থেকে ফেরার সময় টোপরের সঙ্গে কথা বলে টিকলীর মন খুব খারাপ লাগতে লাগল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। ফুটন্ত ফুলগুলো রোদে ঝলসে যাচ্ছে। দুপরের রোদ সহ্য করতে পারছে না। তার ইচ্ছা হল বাগানে গিয়ে ফুলগুলোকে আদর করে বলে আর কিছুক্ষণ কষ্ট কর, একটু পরে সাবুদের বিল্ডিং এর আড়ালে সূর্য চলে যাবে। তখন তোমরা আরাম পাবে। যখনই টিকলীর মন খারাপ হয় তখনই হয় বাগানে যাবে, নচেৎ এই জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। এখন প্রচন্ড রোদ, তাই বাগানে না গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলী প্রতিদিন দুবার গোসল করে। একবার সকালে কলেজে যাওয়ার আগে। আর একবার কলেজ থেকে ফিরে। যেদিন বেশি গরম পড়ে অথবা বিকেলে কোথাও বেড়াতে যায়, সেদিন সন্ধ্যের পরেও একবার গোসল করে। আজ মন খারাপ থাকায় গোসলের কথা ভুলে গেছে।
মেয়েকে ফিরতে সাজেদা বেগম দেখেছেন, ডাইনিং টেবিলে তাকে দেখতে না পেয়ে কাজের বুয়াকে বললেন, দেখত আসমার মা, টিকলী আসছে না কেন?
আসমার মা টিকলীর রুমে এসে বলল, আপা, আপনাকে বেগম সাহেব খেতে ডাকছেন।
টিকলী তখন ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে চার বছর আগের কথা চিন্তা করছিল। তখন সে নাইনে, আর টোপর ইন্টারে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখল, টোপর দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতে বলল, তোর টিকলী নামটা কে রেখেছিল বলত? নামটা কিন্তু দারুণ।
টিকলী বলল, কেন, আজরা মাহবুবা নামটা কি খারাপ? জানিস, নানা একদিন আমাকে আমার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম, জানিনা, আপনি বলে দিন। নানা বললেন, তোর নামের অর্থ হলো, কুমারী প্রিয়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আমার ধারনা তুই বিয়ের আগেই কারো প্রিয়া হবি। শুনে আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম। কারণ তার অনেক আগে থেকেই আমি তোর প্রিয়া। আমার মুখে বোধ হয় হাসি ফুটে উঠেছিল। নানা বুঝতে পেরে বললেন, কিরে হাসছিস যে? আমি তখন লজ্জা পেলাম। তবু বললাম, নামের অর্থ শুনে হাসি পাচ্ছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা। নানা, হাসান শব্দের অর্থ জানেন? নানা বললেন, তা আর জানব না। হাসান অর্থ সুদর্শন। তারপর মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললেন, হাসান নামে কোনো ছেলের সঙ্গে
তোর পরিচয় আছে নাকি? বললাম, আমাদের কয়েকটা বাড়ির পরের বাড়ীর একটা ছেলের নাম হাসান। তারপর আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন ভেবে তার কাছ থেকে চলে এলাম।
টোপর বলল, তোর আসল নামের অর্থ জানতাম না, জানার পর মনে হচ্ছে, দুটো নামই খুব সুন্দর।
টিকলী বলল, আর তোর নাম দুটো বুঝি খারাপ? আমার কাছে আমার নামের চেয়ে তোর নাম দুটো বেশি সুন্দর।
টোপর বলল, হাসান নামটা ভালো হলেও টোপর নামটা বিশ্রি লাগে।
টিকলী হেসে উঠে বলল, কেন, বিশ্রি লাগবে কেন? তুই টোপর পরে বিয়ে করতে আসবি, আর আমি টিকলী পরে কনে সাজবো।
টোপরও হেসে উঠে বলল, কথাটা অবশ্য মন্দ বলিস নি।
টিকলী ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল, আসমার মায়ের কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার দিকে ঘুরে বলল, তুমি যাও, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।
কাহহার সাহেবের ফ্যামিলী খুব আলৰ্টা মর্ডান। ধর্ম সম্পর্কে কেউ কোনো মাথা ঘামায় না। মহল্লার কোনো বাড়ির লোকজনদের সঙ্গেও তেমন মেলামেশা নেই। যাকে বলে আত্মকেন্দ্রিক ও আন-শোসাল মানুষ। নিজেও যেমন কারো সঙ্গে মেলামেশা করেন না, তেমনি ছেলে মেয়েদেরকেও করতে দেন না। কিন্তু তার স্ত্রী শাফিয়া বেগম ঠিক তার উল্টো। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও তার অগোচরে পাড়া-পড়শী মেয়েদের সঙ্গে মাঝে। মাঝে মেলামেশা করেন। এমন কি হালিম সাহেবের স্ত্রী সাজেদা বেগমের সঙ্গেও আলাপ করেন। শাফিয়া বেগম উচ্চ ফ্যামিলীর শিক্ষিত মেয়ে। মা-বাবার পছন্দ করা ছেলেকে সানন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর আচার-আচরণে খুশি হতে না পারলেও ভাগ্যকে মেনে নেন। তারপর যখন প্রতিবেশী হালিম সাহেবদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা জানতে পারেন তখন স্বামীকে মিমাংসা করার কথা অনেকবার বলেছেন। কিন্তু কাহহার সাহেব স্ত্রীর কথা গ্রাহ্য করেন নি।