কেন পারবে না? আজ কাল তো নারী পুরুষের সমান অধিকার। নারীরা আগের যুগের মতো ঘরে থাকে না। এখন তাদের বিচরণ সর্বত্র।
কিছু কিছু বিষয়ে সমান অধিকার পেলেও সব বিষয়ে এখনো পাইনি। যেমন ছেলেরা একাকি দূরে কোথাও যেতে পারলেও মেয়েরা পারে না। ছেলেরা লুঙ্গি, ফুল প্যান্ট বা হাফ প্যান্টের উপর স্যান্ডো গেঞ্জী পরে অথবা খালি গায়ে চলাফেরা করতে পারে; কিন্তু মেয়েরা তা পারে না।
কে বলেছে পারে না। বিদেশের সি-সোরে মেয়েরা দ্বিগম্বরী হয়ে সূর্য স্নান করছে। অলিম্পিক গেমসে মেয়েরা কি পোষাক পরে দেখিস নি? আসলে তুই আমাকে মনে প্রাণে ভালবাসিস না।
এরকম কথা বলতে পারলি? জানিস তোর জন্য আমি জান দিতে পারি?
টোপর বিদ্রূপ কণ্ঠে বলল, যে একটু আদর করতে দেয় না, যে বিয়েও করতে চায়, সে নাকি জান দেবে।
টিকলী বিদ্রূপটা গায়ে মাখল না। বলল, এ দুটো জিনিস ছাড়া তুই যা প্রমাণ চাইবি তাই দেব। দুবছর আগের কথা মনে করে দেখ, যখন আমাদের মা-বাবা আমাদেরকে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছিল তখন আমরা কি বলেছিলাম। এখন যদি গোপনে বিয়ে করি, তা হলে একদিকে যেমন আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে, তেমনি দুই ফ্যামিলীর মধ্যে রক্তারক্তি হবে, মামলা হবে। তুই তো এরকম ছিলি না টোপর। বন্ধুরাই তোকে এরকম করেছে। ওদের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দে টোপর, ছেড়ে দে। কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
টোপর বলল, থাক তোকে আর প্রমাণ দিতে হবে না, আর লেকচারও দিতে হবে না। তুই আর কোনো দিন আমার সামনে আসবি না। আমিও তোর কাছে আসব না, তারপর গাড়িতে উঠে ষ্টার্ট দিল।
টিকলী চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে চোখ মুখ মুছে নিজের গাড়ির দিকে এগোল।
২. টিকলী আর টোপরের বাড়ি
টিকলী আর টোপরের বাড়ি সিদ্ধেশরী রোডে। একজনের বাড়ি থেকে অন্য জনের বাড়ির দূরত্ব এক মিনিটের পথ। দুই বাড়ির মধ্যে ছুরি-কাটারী সম্পর্ক থাকলেও ওরা দুজনে ছোটবেলা থেকে এক সাথে খেলাধুলা করে মানুষ হয়েছে। টোপরের বাবা কাহহার সাহেব ব্যবসায়ী। ভীষণ হিংসুটি, কৃপণ ও শক্ত দিলের মানুষ। দেশের বাড়ি মনোহরদি। প্রথম স্ত্রী চার বছরের একটা ছেলে রেখে মারা যাওয়ার পর শাফিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে। কাহহার সাহেবের আগের স্ত্রীর গর্ভে যে ছেলে, সেই টোপর। তার ভালো নাম হাসান। স্বামীর স্বভাব চরিত্র শাফিয়া বেগমকে কষ্ট দিলেও টোপরকে পেয়ে সেসব ভুলে থাকেন। নিজের পেটের ছেলে-মেয়ের চেয়ে তাকে বেশি আদর যত্ন করেন। ছেলে মেয়ে দুটির নাম শাহিন ও নিশাত। শাহিন নাইনে ও নিশাত সিক্সে পড়ে।
টিকলীর আসল নাম আজরা মাহবুবা। ওরা চার ভাই দুই বোন। বড় তিন ভাই ও এক বোন শিশুকালে মারা গেছে। টিকলী আর তার দুবছরের বড় ভাই আলী বেঁচে আছে। টিকলী সিদ্বেশরী মহিলা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আর আলী ঢাকা ভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে। এ বছর পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের বাবা হালিম সাহেব মিষ্ট্ৰিী অফ হেলথে আছেন। খুব এক রোখা লোক। তবে অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান। প্রথম দিকের তিন ছেলে ও এক মেয়ে মারা যাওয়ায় শেষের দুছেলে মেয়েকে একটু বেশি আদর করলেও নিজের মত সৎ ও আদর্শবান করে গড়েছেন।
হালিম সাহেবের সিদ্বেশরী রোডে দুটো বাড়ি। যে বাড়িতে থাকেন, সেটা অনেক আগে করেছেন। আর যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন, সেটার পাশে কাহহার সাহেবের আগে জায়গা কিনলেও বাড়ি করেছেন পরে। কাহহার সাহেব ফ্যামিলী নিয়ে মধুবাগে থাকতেন। একই দাগ ও খতিয়ানের জমি কেনার সময় বেশ কয়েকবার হালিম সাহেবের বাসায় এসে পরামর্শ করেছেন। কাগজ পত্র দেখেছেন। যে সময় হালিম সাহেব আদর আপ্যায়ণ করিয়েছেন। গন্ডগোল বাধল কাহহার সাহেব যখন মাত্র দুফুট ছাড় দিয়ে চার তলার ফাউন্ডেশন দিলেন। তাও আবার দুফুটের মধ্যে হালিম সাহেবের দশ ইঞ্চি জায়গা। হালিম সাহেব আমিন এনে জায়গা মাপাতে গিয়ে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া হয়। শেষে মহল্লার লোকজন মিমাংসা করে দেন। কাহহার সাহেব হালিম সাহেবের বাড়ীর দিকে ঘরের জানালা দিলেও পাল্লা ভিতরে দেবেন এবং কোনো সানসেড দিতে পারবেন না। কিন্তু কাহহার সাহেব তখন সবার কথা মেনে নিলেও বাড়ি করার সময় মানেন নি। জানালার পাল্লা বাইরেই দিয়েছেন এবং সানসেডও দিয়েছেন। তখন আর একবার ওঁদের ঝগড়া হয়। মহল্লার অনেকে হালিম সাহেবকে বলেছেন, আপনি ডি.আই.টি.তে অবজেকসান দেন। হালিম সাহেব দেওয়ার মনস্থ করলেও শেষ পর্যন্ত দেননি। ভেবেছিলেন, চিরকাল যখন প্রতিবেশী হয়ে বাস করব তখন আর অবজেকসান দিয়ে কি হবে? বাড়ি থেকে বেরোলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা হবে। অবজেকসান দিলে হয়তো ওঁর বাড়ি করাই। বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সাত পাঁচ ভেবে দেননি। কিন্তু কাহহার সাহেবের আচার ব্যবহারে কৃতজ্ঞতার লেশ মাত্র নেই। যখন তখন সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করেন। কয়েকবার একই রকম ঘটনা ঘটার ফলে তার উপর হালিম সাহেবের মন বিষিয়ে গেছে। তাই আজ এত বছর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসাবে বাস করলেও দুই ফ্যামিলীর ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে দিন কাটছিল। হঠাৎ সেই মনোমালিন্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল টিকলি আর টোপরকে নিয়ে। ছোট বেলায় যখন তারা একসঙ্গে স্কুলে যেত ও খেলাধুলা করত তখন দুজনের মা-বাবা ছেলে মেয়েকে প্রথমে বোঝাতেন। কাজ না হতে পরে মারধর করতেন। কিন্তু টিকলী বা টোপর কোনো শাসনই মানত না। একটু বড় হয়ে তারা মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেলামেশা করত। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হল তখন আর তারা গার্জেনদের পরওয়া না করে প্রকাশ্যে মেলামেশা করতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের গার্জেনরা সহ্য করতে পারলেন না। ছেলে মেয়েকে যথেষ্ট রাগারাগি ও তিরস্কার করলেন। টিকলী বা টোপর সে সব গ্রাহ্য না করে যে যার মা-বাবাকে জানাল, আমরা ছোটবেলা থেকে দুজন দুজনকে ভালবাসি এবং সময় মতো বিয়েও করব। এই নিয়ে দুই ফ্যামিলীর মধ্যে মনোমালিন্য আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেল। তবে প্রকাশ্যে তেমন কিছু হল না। কিন্তু তাদেরকে রাগারাগি ও তিরস্কার করতে ছাড়লেন না। তারাও স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তোমরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তা হলে কাজি অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলব। গার্জেনরা বললেন, তা হলে তোদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। তাই টোপর আজ যখন বলল, চল কাল কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। তখন টিকলীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজি না হয়ে এত কিছু বলে বোঝাল।