তাই নাকি? ওর সঙ্গে দেখা হল কি করে।
গতকাল একটা লোক ওকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। এখানে আছে। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। হিরোইনের নেশা করে করে কঙ্কাল হয়ে গেছে। তোমরা সবাই ওর জন্য দোওয়া করো।
তা তো করবই। ধর, আম্মা-আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।
না ভাইয়া, আমার মনের অবস্থা এখন কি রকম তা নিশ্চিয় বুঝতে পারছ। তুমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে চলে এস। আর টোপরের মা-বাবাকে খবরটা দিয়ে তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। সায়কিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার ওর চিকিৎসা করছেন। উনি বলেছেন, ওকে বাঁচাতে হলে আমাদের ও ওর গার্জেনদের উপস্থিতি খবর দরকার।
আলি বলল, আমি পরশু আমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি; কিন্তু আমার কথায় টোপরের মা-বাবা যেতে মনে হয় রাজি হবেন না। তুই নিজে তাকে ফোন করে বল।
টিকলী বলল, ঠিক আছে, তুমি ফোন রেখে দাও। আমি এক্ষুণী করছি।
আলি ফোন রেখে দেওয়ার পর টিকলী টোপরদের বাসায় ফোন করল।
কাহহার সাহেব বাসায় ছিলেন, ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কাহহার সাহেব বলছি।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি কক্সবাজার রহিম আফরোজা হাসপাতালের ডাক্তার বলছি। এখানে আপনার ছেলে টোপর মুমূর্ষ অবস্থায় রয়েছেন। আপনাদের সবাইকে একবার দেখতে চাচ্ছেন।
প্রথম সন্তানের উপর সব মা-বাবার স্নেহ ভালবাসা একটু বেশি থাকে। তাই টোপরের অধঃপতনে রেগে গেলেও পাঁচ-ছ বছর পর খোঁজ পেয়ে পিতৃস্নেহ উথলে উঠল। তার মুমূর্ষ অবস্থার কথা শুনে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলবেন ভেবে চুপ করে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
টিকলী মনে করল, এখনো উনি ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। বলল, বান্দা অন্যায় করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আর আপনি বাবা হয়ে মুমূর্ষ ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। তা ছাড়া ভুল যে আপনারাও করেছেন, তা ভালো করে চিন্তা করলে বুঝতে পারতেন।
কাহহার সাহেব চিন্তা করলেন, টোপর নিশ্চয় ডাক্তারকে সব কথা বলেছে। নচেৎ উনি এরকম কথা বলছেন কেন। ভিজে গলায় বরলেন, হ্যাঁ মা, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরাও ওর প্রতি অবিচার করেছি। আমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে আসছি। টোপর কেমন আছে মা?
টিকলী বলল, অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমরা চিকিৎসার ত্রুটি করছি না। আপনারা দোওয়া করুন, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে দেন। এবার রাখি বলে সালাম বিনিময় করে ফোন রেখে দিল।
ডাঃ সারওয়ারের তত্ত্বাবধানে ও চিকিৎসায় দুতিন দিনের মধ্যে টোপর কিছুটা নরম্যালে এল। মাঝে মাঝে হিরোইনের দেওয়ার কথা বললেও তেমন উত্তেজিত হয় না। তিন দিনের দিন ডাঃ সারওয়ার ডাঃ মাহবুবাকে বললেন, আজ রাত থেকে আপনার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিলাম। হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়ার ব্যাপারটা আপনার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু খুব সাবধান, আপনাকে দেখে যদি আগের মতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর আপনি যদি সামলাতে না পারেন, তাহলে আমাকে কাউকে দিয়ে খবর দেবেন।
ডাঃ মাহবুবা শুধু ধন্যবাদ বলে চুপ করে রইলেন।
এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা যখন টোপরের কেবিনে এল তখন সে ঘুমাচ্ছে। বোরখা খুলে টুলে বসে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। সাড়ে তিনটার সময় টোপরের ঘুম ভেঙ্গে যেতে বুঝতে পারল, হাত পায়ের বাঁধন খোলা। পাশ ফিরে শুয়ে টিকলীকে দেখে রেগে উঠে চিৎকার করে বলল, আপনি আবার এসেছেন? বেরিয়ে যান, নচেৎ আমিই চলে যাব। তারপর বেড থেকে নামতে গেল।
টিকলী তাকে ধরে ফেলে বলল, তুমি খুব দুর্বল টোপর, যেতে পারবে না। আমি তোমার টিকলী। আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করছ কেন? আজ ছয় বছর পর তোমাকে পেয়েছি, কিছুতেই যেতে দেব না।
টোপর চিৎকার করেই বলল, কে টোপর? তাকে আমি চিনি না। টিকলী নামেও কাউকে চিনি না। আমি হাসান। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন; আমি এখান থেকে চলে যাব।
টিকলী তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে যেতে দিলে তো যাবে। আমার একটু ভুলের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে আজ ছয় বছর কি যে অশান্তির আগুনে জ্বলছি, তা উপরের মালিক জানেন। তারপর টোপর রাজশাহী থেকে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে, কি ভাবে তাকে খুঁজেছে বলল। তারপর মা-বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করার কথা, গোপনে এখানে চলে আসার কথা এবং টোপরকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে জিনিয়ার মারফত যে সব চিঠি টোপরকে দিয়েছিল সেগুলো তার হাতে দিয়ে বলল, আমার কথা সত্য না মিথ্যা এগুলো পড়লেই জানতে পারবে। তোমার বন্ধু সাগরও সবকিছু জানে। তাকেও জিজ্ঞেস করে যাচাই করতে পারবে। আমার মা-বাবা ভাইয়া সবাই তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। আর তোমার মা-বাবা ও ভাইবোন ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে অনেক খুঁজেছে। একটা কথা শুনে রাখ, তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর, তা হলে আমিও তোমার মতো হিরোইনের নেশা করতে বাধ্য হব।
চিঠিগুলো পড়ে ও টিকলীর কথা শুনে টোপর নিথর হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ঐ জঘন্য নেশার নাম মুখে এনো না। ঐ নেশা করে আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। তুমি ওর ধারে কাছেও যেও না। আমাকে এবার যেতে দাও টিকলী; মৃত্যু আমাকে ডাকছে। পারলে ক্ষমা করো।