ডাঃ সারওয়ার বললেন, যদি অনুমতি দেন, কয়েকটা প্রশ্ন করব।
করুন।
এই রুগী কী আপনার পরিচিত?
হ্যাঁ।
কিছু হয় কী আপনার?
ডাঃ মাহবুবা কি বলবে ঠিক করতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
প্লীজ ম্যাডাম, চুপ করে থাকবেন না। আমি মনে করি, ওঁকে বাঁচাতে হলে আপনার সাহায্য খুব দরকার। ডাক্তার হিসাবে কথাটার গুরুত্ব নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
বুয়াকে চা নিয়ে আসতে দেখে ডাঃ মাহবুবা বললেন, চা খেয়ে নিন, বলছি। চা খাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা প্রথমে নিজের ও টোপরের বায়োডাটা বললেন। তারপর ছোটবেলার সম্পর্ক থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব বলে বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমার কারণেই ওঁর আজ এই অবস্থা। ওঁকে বাঁচাবার জন্য আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, যারা হিরোইনের নেশা করে, তারা চার পাঁচ বছরের বেশি বাঁচে না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি প্রায় ছয় বছর ধরে নেশা করছেন। এখনো যে বেঁচে আছেন, ভাবতেই খুব অবাক লাগছে। এই জন্যেই বোধ হয় কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে? অবশ্য কোরআনপাকেও আছে, আল্লাহ হায়াৎ মউতের মালিক।
ডাঃ মাহবুবা ভিজে গলায় বললেন, এ কথা মুসলমান মাত্রেই জানে। আপনি আপনার সাধ্যমতো চিকিৎসা করুন। আমি আমার সাধ্যমত সব কিছু করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, কি সাহায্য দরকার, তা ডাক্তার হিসাবে আপনি নিশ্চয় জানেন। তবু বলছি, আপনার প্রতি ওর ঘৃণা বা বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করবেন। আপনার ও ওঁর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই যে তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত এবং সেই জন্যে ওঁকে যে তারা এখনো খুঁজছেন, সে কথা বিশ্বাস করাতে হবে।
ডাঃ মাহবুবা বললেন, আমি ওঁর জন্য সবকিছু করব। আপনি শুধু একটু ভালো করে কেয়ার নেবেন।
এটা আমার কর্তব্য, আপনি না বললেও নিতাম। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে ডাঃ সাওয়ার বললেন, রাত একটার দিকে ওঁর ঘুম ভাঙ্গবে। আমি নার্সকে থাকতে বলেছি। কোনো রকম অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিতেও বলেছি। আমি না বলা পর্যন্ত আপনি ওঁর কাছে যাবেন না। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আসতে পারেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
ডাঃ মাহবুবা এশারে নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। তারপর টোপরের কেবিনে এলেন।
ইয়াসমীন টুলে বসে ছিল। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
ডাঃ মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আপনি যান। নামায পড়ে খেয়ে দেয়ে আসুন। আমি ওঁর ঘুম ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত আছি।
ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ টোপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর টুলটা বেডের কাছে এনে বসে তার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে দুহাত তুলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফরিয়াদ করলেন, হে রাবুল আলামিন, তুমি বিশ্বব্রহ্মান্ডের একমাত্র মহান প্রভু। তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। তুমি অসীম দয়ালু। তাই যারা তোমাকে অস্বীকার করে এবং যারা তোমার আদেশ নিষেধ অমান্য করে। তাদেরকে ও তুমি জীবন-যাপন করার অবসর দিয়েছ। আমি তোমার একজন নাদান। বান্দী হলেও তোমার পেয়ারা হাবিব হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর উম্মত। সেই হাবিবে পাকের উপর শত কোটি দরূদ ও সালাম পেশ করে ফরিয়াদ করছি, তুমি টোপরকে ভালো করে আমাকে তার স্ত্রী হিসাবে কবুল কর। তুমি অন্তর্যামী। আমাদের দুজনের অন্তরের সব কিছু জান। তোমার মনোনীত প্রিয় বান্দারা ছাড়া প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু গোনাহ করে থাকে। আমিও করেছি। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে ও টোপরকে ক্ষমা করে আমাদের মনের নেক মকসুদ পূরণ কর। তুমি ক্ষমা না করলে মানুষের পরিত্রানের কোনো উপায় নেই। তুমি কোরআন পাকে বলেছ, হে আমার বান্দাগণ যাহারা নিজের উপর অত্যাচার করিয়াছ, তোমরা আল্লাহতায়ালার রহম হইতে নিরাশ হইও না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করিবেন; নিশ্চিয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা-যুমার, ২৪-প্যারা, ৫৩ নং আয়াত।] তোমার পবিত্র বানী মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের জোরে তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, তোমার হাবিবে পাকের অসিলায় আমাকে ক্ষমা করে আমার দোওয়া কবুল কর। আমিন, সুম্মা আমিন।
মোনাজাত শেষ করে চোখ মুখ মুছে টোপরের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলেন। এগারটার সময় ইয়াসমীন ফিরে এলে বললেন, আমি স্যুপ পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওঁর ঘুম ভাঙ্গলে খাওয়াবেন। যদি খেতে না চান অথবা তেমন কিছু উৎপাত করেন, তা হলে ডাঃ সারওয়ারকে খবর দেবেন।
ইয়াসমীন প্রথমেই বুঝতে পেরেছে, ইনি নিশ্চয় ম্যাডামের আপনজন। বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ডাঃ সারওয়ার আমাকে সবকিছু নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ডাঃ মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে কোয়ার্টারে ফিরে এসে ফ্রীজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে স্যুপ তৈরী করে বুয়ার হাতে পাঠিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকালে ডাঃ মাহবুবা ঢাকায় ফোন করলেন।
আলি ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিল। ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কাকে চান?
ডাঃ মাহবুবা ভাইয়ার গলা বুঝতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভাইয়া, আমি টিকলী, কক্সবাজার থেকে বলছি। তোমরা সব কেমন আছ?
আল্লাহরপাকের দোওয়ায় ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
আমিও আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি। ভাইয়া শোন, টোপরের দেখা আল্লাহ মিলিয়েছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ।