সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিনিয়া চিঠিটা আলির হাতে দিল।
আলি পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর ঠিকানা দেয়নি দেখে বলল, খামের উপর জি.পি.ওর সীল। মনে হয়, ঢাকায় অথবা কাছাকাছি কোন ক্লিনিকে আছে।
জিনিয়া বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, দুরে কোনো মফস্বলের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে আছে। ঠিকানা জেনে যাব বলে কারো হাতে ঢাকায় পোষ্ট করতে দিয়েছে।
তাও হতে পারে, তবু তুমি ঢাকার আশপাশের ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নাও।
খোঁজ নিয়েছি, আবার না হয় নেব। এখন যাই, আম্মা-আব্বাকে জানাতে হবে। তরপর বিদায় নিয়ে আলি বাসায় এসে তাদেরকে জানাল। হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
ঠিকানা দেয়নি শুনে সাজেদা বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন, তুই আবার সব ক্লিনিকে খোঁজ কর।
আলি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর কয়েক দিন ধরে খোঁজ করেও পেল না। প্রায় একবছর খোঁজ করেও যখন পাওয়া গেল না তখন জিনিয়ার সঙ্গে আলির বিয়ে হয়ে গেল। এর মধ্যে টিকলী মা-বাবাকে দুটো চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ঠিকানা দেয়নি।
বিয়ের মাসখানেক পর আলি জিনিয়াকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এল। এখানকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারল, সমুদ্র। সৈকতের কাছে রহিম-আফরোজা নামে নতুন একটা হাসপাতাল হয়েছে।
একদিন সকালে নাস্তা খেয়ে সেখানে গিয়ে টিকলীর দেখা পেল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে টিকলী তাদেরকে বসতে বলল। তারপর বলল, তোমরা নিশ্চয় বিয়ে করেছ?
আলি বলল, আমি চেয়েছিলাম তোকে খুঁজে বের তারপর বিয়ে করব। জিনিয়ার। মা-বাবা বললেন, তোমার মা-বাবা জিনিয়াকে কাছে পেলে টিকলীর শোক কিছুটা অন্ততঃ ভুলতে পারবেন। একরকম বাধ্য হয়ে মাসখানেক আগে করতে হল। তা তুই আত্মগোপন করলি কেন? পেপারে আব্বা যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, পড়িসনি?
পড়ার পর জিনিয়াকে তো দুটো চিঠি দিয়েছি। তারপরও আব্বা-আম্মাকে দুটো দিয়েছি।
কিন্তু ঠিকানা দিসনি কেন? আম্মা তোর জন্য কত কাঁদে জানিস? টিকলীর চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, ওসব কথা থাক, এটা অফিস, এখানে ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশী সময় দিতে পারব না। তোমরা আমার কোয়ার্টার গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি ঘন্টা খানেক পরে আসছি। তারপর একজন পিয়নকে ডেকে বলল, ইনাদেরকে আমার কোয়ার্টারে দিয়ে এস।
একঘন্টা পরে টিকলী কোয়াটারে এসে ভাইয়ার কাছ থেকে সে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে সব শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা ফিরবে কবে?
আলি বলল, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম, কাল চলে যাব।
আজ দুপুরে ও রাতে তোমরা এখানে খাবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার সময় আলি টিকলীর ফোন নাম্বার নিয়ে বলল, কয়েক দিনের জন্য তুইও আমাদের সঙ্গে চল।
টিকলী বলল, পুরো হাসপাতালের দায়-দায়দায়িত্ব আমার উপর। এখন থেকে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আব্বা-আম্মাকে আমার ছালাম দিয়ে বললো, তারা যেন। আমাকে মাফ করে দেয়।
তুই কি সারাজীবন বিয়ে করবি না?
সেকথা আল্লাহপাক জানেন। তোমাকে তো অনেক আগেই বলেছি, টোপরের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব।
কিন্তু সে যদি মারা গিয়ে থাকে?
টিকলী চমকে উঠে ভাইয়া বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাগ করবে না বল?
না, বল কি জিজ্ঞেস করবি।
কোনো কারণে জিনিয়া যদি হারিয়ে যেত, তা হলে তুমি কি অপেক্ষা করতে না?
আলিও চমকে উঠে একবার জিনিয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তারপর ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ করতাম। তোকে আর এ ব্যাপারে কোনো দিন কিছু জিজ্ঞেস করব না।
জিনিয়া টিকলীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
টিকলী চেখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, কাঁদছ কেন ভাবী? জীবন আর কয় দিনের। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। তার অর্ধেক তো পার হয়ে গেছে। বাকিটা রুগীদের সেবা করে কাটিয়ে দেব। তারপর তাদেরকে গাড়িতে তুলে দিল।
এর কয়েক দিন পর কে বা কারা আজ টোপরকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে মাগরিবের আযান হয়ে গেছে ডাঃ মাহবুবা জানতে পারলেন না। বুয়া যখন এসে বলল, আপামনি আযান হয়ে গেছে, নামায পড়বেন না তখন হুশ হল। বললো, হ্যাঁ পড়ব।
নামাজ পড়া শেষ হয়েছে, এমন সময় নার্স ইয়াসমীন এসে বলল, ম্যাডাম, রুগীর ঘুম ভেঙ্গেছে। আমাকে হিরোইন দাও, নচেৎ এখান থেকে চলে যাব, বলে বেড থেকে নেমে পড়েছিলেন। আমরা দুতিন জন মিলে বেডের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রেখে আপনাকে জানাতে এলাম।
ডাঃ মাহবুবা বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে বোরখা পরে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন, ওঁকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
ইয়াসমীন বলল, জ্বী
ডাঃ মাহবুবা এখানে মাদকে আসক্ত রুগীর সংখ্যাধিক্য দেখে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার কে ঢাকা থেকে আনিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি কয়েক জন রুগীকে চিকিৎসা করে ভালোও করেছেন।
কেবিনের দরজার কাছে এসে ডাঃ মাহবুবা বললেন, আপনি ডাঃ সারওয়ারকে ডেকে নিয়ে আসুন। তারপর কেবিনে ঢুকে বেডের কাছে এগিয়ে এলেন।
টোপর তাকে চিনতে পারল না। কারণ ডাঃ মাহবুবার চোখ দুটো ছাড়া সারা শরীর ও মুখ বোরখা দিয়ে ঢাকা। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?