শাহিন এখন বড় হয়েছে। ভালোমন্দ জ্ঞান হয়েছে। বলল, আপনি ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করবেন তো?
হ্যাঁ ঠিক বলেছ, তুমি ওর আমেরিকার ঠিকানাটা দাও তো।
শাহিন কিশোর বয়সে মায়ের কথা মত মিথ্যা বলেছিল। এখন তা পারল না, বলল, আপা, আমি আপনাদের সব কথা জানি। আপনি এখনো ভাইয়াকে ভুলতে পারেননি শুনে খুব দুঃখ হচ্ছে। আপনি ভাইয়াকে ভুলে যান আপা।
টিকলী খুব অবাক হয়ে বলল, আমি তোমার বড় বোনের মত। তুমি আমাকে একথা কেন বলছ বল তো?
শাহিন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্রায় তিন বছর আগে আপনাকে যে কথা : বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। ভাইয়াকে বাবা আমেরিকায় পাঠায়নি।
কি বললে আমেরিকা পাঠায়নি?
না আপা, সে সময় মা নিষেধ করেছিল বলে মিথ্যা বলেছিলাম। এখন আর কোনো কথা আপনার কাছে গোপন করব না। ভাইয়ার যে ছয় মাসের জেল হয়েছিল, তা নিশ্চয় শুনেছেন। জেলে কোনো কয়েদির পাল্লায় পড়ে হিরোইনের নেশায় ধরেছিল। ছাড়া পেয়ে মা বাবার কাছে দুহাজার টাকা চায়। না দিতে একরাতে আমরা সবাই পাশের বাসায় বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে ভাইয়া ষ্টীলের আলমারী থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
টিকলী কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঠোঁট কামড়ে সামলাবার চেষ্টা করতে লাল।
তার অবস্থা দেখে শাহিনের চোখে আবার পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, যারা একবার হিরোইনের নেশা শুরু করে তারা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ছাড়তে পারে না। বেশি দিন বাঁচেও না। ভাইয়া কি আর এত দিন বেঁচে আছে? আপনি তাকে ভুলে যান। আপা ভুলে যান। তারপর দ্রুত হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল।
টিকলী স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলীও গাড়ি নিয়ে এসেছে ড্রাইভার বেশ বয়স্ক লোক। এতক্ষন মালিক কন্যাকে লক্ষ্য করছিল, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল, বাসায় যাবেন না মা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুখ মুছে বলল, হ্যাঁ চাচা চলুন।
টিকলী বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, কিরে এত দেরি করলি যে, তাড়াতাড়ী ফিরতে বলছিলাম না।
টিকলী জানে ভাইয়া জিনিয়াদের বাসায় যাবে। অন্য সময় হলে দুষ্টুমী করে বলত, বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি যেতে তোমার লজ্জা করে না? আজ মন খারাপ থাকায় দুষ্টুমী করে বলল, সরি ভাইয়া, তারপর কান্না চেপে রাখতে না পেরে ছুটে ভিতরে চলে গেল।
আলি তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে, একটু আগে কেঁদেছে। আবার বেসামাল অবস্থায় চলে যেতে দেখে চিন্তা করল, তা হলে কি টোপরের কোনো খারাপ খবর পেয়েছে? এমনি দেরি হয়ে গেছে তাই ফিরে এসে জিজ্ঞেস করবে ভেবে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
টিভিতে রাত দশটার খবর সবাই এক সঙ্গে শোনে। আজ টিকলী নেই দেখে আলি তার রুমে গিয়ে দেখল, বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
ছোট বোনের জন্য আলির খুব মায়া হল। পাশে বসে মাথায় একটা হাত রেখে বলল, বিকেলে কান্না ভেজা মুখে বাসায় ফিরলি। এখন আবার কাঁদছিস, কি হয়েছে বল সাধ্যমত সাহায্য করব। টোপরের কি কোনো খবর পেয়েছিস?
টিকলী কান্না থামিয়ে উঠে বসে ভিজে গলায় বলল, টোপর আমেরিকায় যায়নি। তারপর শাহিনের কাছে যা শুনেছে সে সব বলে বলল, ও দেশের কোথাও না কোথাও আছে।
আলি বলল, এত ভেঙ্গে পড়িসনি বোন, সবর কর। জানিস না, আল্লাহ কোরআন পাকে সবর করতে বলেছেন। আমি তার অনেক বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ করেছি। তারা কেউ তার খবর বলতে পারেনি। এমন কি আমেরিকা গেছে কিনা তাও বলতে পারেনি। তুই তো ডাক্তারী পড়িস, এটা নিশ্চয় জানিস, যারা হিরোইনের নেশা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না। আমার মনে হয়, সে বেঁচে নেই। থাকলে এতদিনে নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যেত। তাকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত।
ভাইয়া তুমি অমন কথা বলো না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আমার মন বলছে, সে বেঁচে আছে এবং দেশেই আছে। তুমি যাও ভাইয়া আমাকে একা থাকতে দাও।
আলি আর কিছু না বলে চলে এল।
এরপর আরো তিন বছর পার হয়ে গেল। টোপরের খোঁজ খবর নেই। ডাক্তারী পাশ করার পর এক বছর ইন্টার্নশিপ করে টিকলী রাজশাহী মেডিকেলে থেকে গেল।
হালিম সাহেব রিটায়ার্ড করেছেন, আলি মাষ্টার্স করে বাবার অফিসেই চাকরি পেয়েছে। জিনিয়ার সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। টিকলীর জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। ভাইবোনের বিয়ে এক সঙ্গে হবে।
ইদানিং উচ্চ ধনী ঘরের এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সন্ধান পেয়ে হালিম সাহেব ফোন করে মেয়েকে বললেন, আমরা তোর জন্য ভালো পাত্র দেখেছি। তুই দুএক দিনের মধ্যে চলে আয়।
টিকলী বলল, আমি বিয়ে করব না তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দাও। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
হালিম সাহেব মেয়ের মতামত স্ত্রীকে ও ছেলেকে জানালেন।
আলি বলল, তুমি আম্মাকে নিয়ে যাও। খালা খালুর সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখ, যদি রাজি করাতে পারো।
মাজেদা বেগম বললেন, তুইও চল।
আলি নিশ্চিত, টিকলী টোপরকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তাই বলল, অফিসে ছুটি দিবে কিনা ঠিক নেই, তোমরাই যাও।
হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম রাজশাহী গিয়ে মেয়েকে অনেক বোঝালেন। সাজেদা বেগমের বড় বোন ও দুলাভাই রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু পারলেন না।