সাগর সঙ্গের ছেলেটাকে বলল, একটু বস, আসছি। তারপর টিকলীর কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কি ব্যাপার?
টিকলীও স্কুটার থেকে নেমে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি টোপরের কোনো। খোঁজ পেয়েছেন?
না, তবে কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না, আজ আসার সময় তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। টোপর বাসায় আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বলল, দুদিন আগে সে আমেরিকা চলে গেছে।
তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। এবার মানুষ হয়ে যাবে।
কিন্তু কথাটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
তা বলতে পারব না, এমনিই বিশ্বাস করতে পারছি না।
সাগর মৃদু হেসে বলল, অবিশ্বাস করার কি আছে, ওর তো যাওয়ারই কথা ছিল। আর সত্যি সত্যি যদি না গিয়ে থাকে, তবে আমি নিশ্চয় জানতে পারব। জানার পর আপনাকে চিঠি দিয়ে জানাব।
টিকলী ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, অনুগ্রহ করে ভালো মতো খোঁজ নেবেন। আমি আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকব।
সাগর বলল, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব। আমার মনে হয়, আমেরিকায় গিয়ে থাকলে আপনাকে চিঠি দেবে।
আল্লাহ যেন তাই করেন বলে টিকলী বলল, আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি, মনে, কিছু নেবেন না।
সাগর বলল, কষ্ট আবার কি? বন্ধু হিসাবে আমারও কিছু কর্তব্য আছে। আর কিছু বলবেন?
না, এবার আসুন। বলে টিকলী সালাম বিনিময় করে স্কুটারে উঠে সিদ্ধেশ্বরী রোডে যেতে বলল।
বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, সারাদিন কোথায় কোথায় যাস? তোকে তো বাসায় পাওয়াই যায় না। তার ধারনা টিকলী টোপরের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরে বেড়ায়, তাই কথাটা একটু রাগের সঙ্গে বলল।
টিকলী কিছু না বলে ছলছল চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
তাই দেখে আলি নরম সুরে বলল, তুই এখনো টোপরকে ভুলতে পারিস নি? টোপর হিরোইনের নেশা করে। টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু কেন করে তুমি না জানলেও আমি জানি। আমার জন্যই আজ ওর এই পরিণতি। তারপর কান্না চাপতে চাপতে সেখান থেকে ছুটে চলে গেল।
বোনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আলির চোখেও পানি এস গেল। বিড় বিড় করে দোওয়া করল, আল্লাহ তোকে টোপরকে ভুলার তওফিক দিক। তোকে হেফাজত করুক।
পরের দিন রাজশাহী যাওয়ার জন্য আলি টিকলীকে কমলাপুর ট্রেনে তুলে দিতে এল। ট্রেন ছাড়ার আগে টিকলী বলল, শাহিনের কাছে শুনলাম, সে আমেরিকা চলে গেছে। কথাটা যদি ঠিক হয়, তা হলে শাহিনের কাছ থেকে তার ঠিকানাটা নিয়ে আমাকে জানাবে।
আলি বলল, ঠিক আছে জানাব।
প্রায় তিন ঘন্টা ডাঃ মাহাবুবা চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের আগের জীবনের স্মৃতিচারন করে চলেছেন। এমন সময় কারো ম্যাডাম ডাকে বাস্তবে ফিরে এলেন। তাকিয়ে ইয়াসমিনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ রুগী কেমন আছেন?
এখনো ঘুমাচ্ছেন।
আমি কোয়ার্টারে যাচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গার পর চার্ট দেখে ঔষুধ খাওয়াবেন। কোন রকম অসুবিধা করলে আমাকে খবর দেবেন।
ইয়াসমিন জ্বি আচ্ছা বলে চলে গেল।
ডাঃ মাহবুবা বাসায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আসরের নামায পড়লেন। তারপর বারান্দায় চেয়ারে বসে মাসিক মদিনা পত্রিকা পড়ার জন্য হাত বাড়ালেন। এমন সময় কাজের মেয়ে জোহরা চা-বিস্কুট নিয়ে এলে পত্রিকা রেখে দিলেন। তারপর দুটো বিস্কুট ও একগ্লাস পানি খাওয়ার পর চা খেয়ে পত্রিকাটা হাতে নিলেন। আরো দুতিনটে পত্রিকা ও দৈনিক পেপার রাখেন। মাসিক মদিনা তার খুব প্রিয়। এতে যেমন অতীত যুগের মুসলমানদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, তাঁদের উন্নত চরিত্রের কথা, মুসলিম মনীষীদের অমীয় বানী ও তাঁদের জীবন চরিতের সমালোচনা থাকে, তেমনি এমন কিছু প্রশ্ন উত্তর থাকে যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা একান্ত জরুরী। পত্রিকা পড়ার জন্য খুললেন বটে, কিন্তু পড়তে পারলেন না। তখন তার মনের পাতায় আবার পূর্ব জীবনের কথা ভেসে উঠল।
টোপর আমেরিকা চলে গেছে শুনে টিকলী রাজশাহী চলে এসেছিল। তারপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টোপরের চিঠির অপেক্ষা করছে। আর মাসে মাসে দুতিন খানা করে জিনিয়াকে ও সাগরকে চিঠি দিয়ে টোপরের আমেরিকায় ঠিকানা জানাতে বলেছে। চার-পাঁচ মাস পরপর ঢাকায় এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা কেউ টোপরের আমেরিকার ঠিকানা দিতে পারেনি। নিজেও কয়েকবার টোপরের ছোট ভাই শাহিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছে। শাহিন জানে না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। টিকলীর দৃঢ় ধারনা টোপর আমেরিকা যায়নি। সে দেশেই অন্য কোথাও আছে।
বোনের অবস্থা দেখে আলি তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য অনেক বুঝিয়েছে, টিকলী তাকে বলেছে, এ জীবনে তাকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ওর ব্যাপার নিয়ে কিছু বলল না। আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব। তুমি শুধু আমাকে টোপরের ঠিকানা জোগাড় করে দাও। আমি আর কোনো দিন কোনো কিছু তোমার কাছে চাইব না।
প্রায় বছর তিনেক পর টিকলী একদিন ঢাকা নিউমার্কেটে বই কিনতে গিয়েছিল। ফেরার সময় গেটের বাইরে শাহিনের সঙ্গে দেখা, শাহিন তখন কলেজে পড়ে। সেও বই কিনতে গিয়েছিল।
শাহিন তাকে দেখে চিনতে পারল, বলল, কিছু বলবেন?
হ্যাঁ এদিকে এস। শাহিন এগিয়ে এলে বলল, আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারছ?
শাহিন ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব সঠিক উত্তর দেবে?