টিকলী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, আপনি ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু, আপনি ওকে ঐ জঘন্য নেশা থেকে বাঁচান। আর আমাকে বলে দিন আমি কি করব। ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি সত্য। তারপর কেন ফিরিয়ে দিয়েছে সে কথা বলে বলল, এবার আপনিই বিচার করুন, আমার অন্যায় কতটা। ও বড় জেদী। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেমন কোনো কাজ করে না; তেমনি কারো ভাল কথাও শুনতে চায় না।
সাগর বলল, ওর এই স্বাভাবের কথা আমি জানি। আমি ওর এই জঘন্য নেশা ছাড়াতে পারব কিনা জানি না, তবে আমার বিশ্বাস, আপনিই একমাত্র ওকে ঐ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
উপায়টা বলে দিন।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা বিয়ে করে ফেলুন।
টিকলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ, তাই করব। আমি কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহী চলে যাচ্ছি। সেখানে ওকে নিয়ে আপনিও আসুন।
সাগর বল, ঠিক আছে, তাই হবে। তবে এর মধ্যে টোপরকে আপনি কথাটা জানান। কি করে জানাব? ওকে পাওয়াই যায় না। এখানে আসার সময় বেলী রোডের মুখে হঠাৎ দেখা। কিছু বলার আগে ছুটে পালিয়ে গেল। অনেক কিছু বলেও ফেরাতে পারলাম না।
তবু যেমন করে হোক দেখা করে কথাটা ওকে বলুন। জেল থেকে বেরিয়েছে। ছমাস হল। একবারও আমার কাছে আসেনি। আজ এসেছিল টাকার জন্য।
আপনি একটু কষ্ট করে ওকে কথাটা জানিয়ে রাজশাহী নিয়ে আসুন। আমিও যাওয়ার আগে দেখা করে কথাটা জানাবার চেষ্টা করব। তারপর বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
ঐদিন টোপর সাগরের কাছে টাকা না পেয়ে আসলামের সঙ্গে দেখা করে বলল, আপনি আর আমাদের বাসায় যাবেন না। দুচার দিনের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবেন।
আসলাম বলল, ঠিক আছে, কিন্তু এর মধ্যে না পেলে বাসায় যেতে বাধ্য হব।
তার আগেই পেয়ে যাবেন বলে টোপর সেখান থেকৈ ফেরার পথে মৌচাক মার্কেট থেকে একটা বড় চাকু ও একটা খেলনা পিস্তল কিনল। বাসায় এসে চিন্তা করল, মা যদি টাকা না দেয় তা হলে কাল থেকে রাহাজানী করবে।
আজ সকালে নাস্তার টেবিলে শাফিয়া বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি তো শুধু ব্যবসা নিয়ে থাক। এদিকে টোপর ঘুম থেকে সকাল নয়টার সময় উঠে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত বারটার দিকে। পড়াশোনাও করে না। কারও সঙ্গে কথাও। বলে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। ওর দিকে তোমার লক্ষ্য করা উচিত।
কাহহার সাহেব তখন কিছু না বলে অফিসে চলে গেলেন।
রাতে খাওয়ার পর টোপরকে ডেকে পাঠালেন।
টোপর এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেখানে শাফিয়া বেগমও ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? বস।
টোপর বসার পর কাহহার সাহেব বললেন, তুই কি আর ভার্সিটি যাসনি?
টোপর চুপ করে রইল।
কি হল, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
না।
কেন?
আমি আর পড়াশোনা করব না।
কারণটা জানতে পারি?
ভালো লাগে না।
কি করবি তা হলে?
টোপর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কাহহার সাহেব এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললন, শত্রুর মেয়ের জন্য নিজের উজ্জল ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করে মাস্টার্স শেষ কর। আরো উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য তোকে তো ফরেনে পাঠাব বলেছি। আর হাত খরচের জন্য মাসে যা পাস তাই দিয়ে চল। অযথা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে টাকা নষ্ট করিস না। সন্ধ্যের পর পর বাসায় ফিরবি। আর তোর মাকে যে দুহাজার টাকার কথা বলেছিস, তা এখন পাবি না। আমার কথা মতো চললে মাসখানেক পরে পাবি। যদি না চলিস, তা হলে ঐ টাকাতো পাবিই না, উপরন্তু হাত খরচের টাকাও পাবি না। এবার তুই যেতে পারিস।
কিন্তু বাবা, দুহাজার টাকাটা যে আমার ইমিডিয়েট দরকার।
তোর মায়ের কাছে সে কথা শুনেছি। বন্ধুর কাছে এক মাস সময় চেয়ে নে।
টাকাটা অনেক আগে নিয়েছি। সে আর এক মাস দেরি করবে না। দুএকদিনের মধ্যে দিতেই হবে।
তোর কোন কথাই শুনতে চাই না। যা যা বললাম তাই কর।
টাকাটা এখন না দিলে পরিণামের জন্য তোমরাই দায়ী হবে।
কাহহার সাহেব রেগে উঠে বললেন, কি? তোর এতবড় সাহস, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? চলে যা এখান থেকে, এক পয়সায়ও দেব না। দেখি তুই কি করিস।
কাজটা তুমি ভালো করলে না বাবা। বলে টোপর নিজের রুমে চলে এল। সারারাত ঘুমাতে পারল না। সাগরের কথা, টিকলীর কথা চিন্তা করে কাটাল। মায়ের উপরও খুব অভিমান হল। নিজের মা হলে এরকম করতে পারত না।
পরের দিন টোপর আসলামের কাছে গয়ে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব। আপনারা যা করেন আমিও তাই করব।
আসলামের বাড়ি পটুয়াখালি। হলে থেকে ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স করার সময় একটা মেয়ে সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। মাস্টার্স করার সময় মেয়েটার আমেরিকা প্রবাসী এক আত্মিয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে হিরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার বন্ধুরাও শিক্ষিত বেকার। অনেক দিন চাকরির চেষ্টা করেও পায়নি। তাই হাইজ্যাক, রাহাজানী ও চাদাবাজী করে দিন কাটায়। ওরা চারবন্ধু কমলাপুরে একটা মেসে থাকে। খুন খারাপী না করলেও একবার চাঁদাবাজী করতে গিয়ে মারামারি করে। তাতে আসলামের পিস্তলের গুলিতে ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার আহত হন। আর আসলাম ধরা পড়ে যায়। এ্যাটেম টু মার্ডারের কেসে আসলামের দুবছরের জেল হয়। ছাড়া পাওয়ার নয় মাস আগে জেলে টোপরের সঙ্গে পরিচয় হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আসলাম পুরোনো বন্ধুদের দলে ভিড়েছে।