টোপর টিকলীর নাম শুনে জ্বলে উঠল। বলল, ওর কথা বলবি না, ও আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। ওর জন্যেই আমার আজ এই পরিণতি।
সাগর বলল, তোর মত বুন্ধু দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় নেই। আরে তোকে তো কতবার বলেছি, আরো হাজার টিকলী রয়েছে। তাদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে বেছে নে। তুই তো আমার কথা শুনলি না। আরে বাবা, যৌবন আর কয় দিনের? যতটা পার মজা লুটে নাও। যাক বাদ দে ওসব কথা। এখন হিরোইন ছাড়বি কিনা বল।
টোপর বলল, আমি ছাড়তে চাইলেও হিরোইন আমাকে ছাড়বে না। আমার এখন এমন অবস্থা একদিন হিরোইন না নিলে পাগল হয়ে যাব। তুই টাকাটা দিবি কিনা বল, নচেৎ আমাকে অন্য চেষ্টা করতে হবে।
সাগর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, যা বললাম, তা যদি মেনে নিস, তা হলে দেব।
টোপর কোন কথা না বলে হন হন করে চলে গেল। ফেরার পথে চিন্তা করল, মা টাকা না দিলে রাহাজানী, ছিনতাই করে জোগাড় করবে, মায়ের অথবা বাবার টাকা চুরি করবে। বাস থেকে শান্তিনগরের মোড়ে নেমে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠেছে এমন সময় টিকলীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
টোপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এই ছয় মাসের মধ্যে টিকলী প্রতিমাসে ঢাকায় এসে তার সঙ্গে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। সাগর নামে টোপরের যে একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু আছে তা টিকলী জানত। টোপরই তার কথা প্রায় বলত। কিন্তু তার বাসার ঠিকানা বলেনি। তাই জিনিয়াকে বলেছিল, সাগরের বাসার ঠিকানা জানতে। জিনিয়া অনেক বুদ্ধি খরচ করে সাগরের পার্টির এক মেয়ের দ্বারা ঠিকানা জোগাড় করেছে। টিকলী পরশু এসে কাল তার কাছ থেকে ঠিকানা এনেছে। আজ সাগরের কাছে টোপরের খোঁজ নেওয়ার জন্য যাচ্ছিল। নিউ বেইলী রোডের মাথায় দেখা হয়ে গেল।
কয়েক সেকেণ্ড কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্ট্রে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় টিকলীর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তাই দেখে টোপর পাশ কেটে দ্রুত চলে যেতে লাগল। টিকলী চোখ মুছে তাকে অনুসরণ করে বলল, টোপর দাঁড়াও কথা আছে, যেওনা বলছি। তবু টোপরকে চলে যেতে দেখে আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বলল, প্লীজ টোপর দাঁড়াও, একটা কথা অন্তত শুনে যাও।
টোপর দাঁড়াল না, বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে দৌড়ে পালাতে লাগল।
টিকলী গলির মুখে এসে তাকে দৌড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
রাণু নামে তাদেরই মহল্লার একটা জানালোনা মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। সে ক্লাস এইটে। পড়ে। টিকলীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখে বলল, কি হয়েছে আপা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, না কিছু হয়নি, তুমি যাও। তারপর রাস্তা পার হয়ে বাস স্ট্যাণ্ডে এল।
রানু বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, টিকলী আপার মতো মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল কেন? কারণটা বুঝতে না পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল।
সাগরের বাসা যাত্রাবাড়ি। টিকলী বাস থেকে নেমে কিছুটা এসে একটা ভদ্র ও সুন্দর যুবককে ঠিকানা দেখিয়ে বলল, বাসাটা কোনখানে বলতে পারেন?
সাগর একজন পর্দানশীল মেয়ের হাতে নিজের নাম ঠিকানা দেখে খুব অবাক হল। বলল, এটা আমাদের বাসার ঠিকানা, আমিই সাগর। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি টিকলী। টোপরের কাছে নিশ্চয় আমার কথা শুনেছেন?
সাগর টোপরের কাছে টিকলীর রূপের কথা শুনেছে, কখনো দেখেনি। মনে মনে তারিফ করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ শুনেছি। আসুন কাছেই আমাদের বাসা।
যেতে যেতে টিকলী বলল, টোপরের কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি।
সাগর তাকে বাসায় নিয়ে এসে ড্রইংরুমে বসতে বলে ভিতরে গেল। একটু পরে ফিরে এস বলল, আপনি কেন এসছেন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। টোপর আপনাকে আমার সম্বন্ধে তালো মন্দ যাই বলুক না কেন, একটা কথা বিশ্বাস করুন, আমি টোপরের কখনো খারাপ কিছু চিন্তা করিনি। বরং তার ভালোর চিন্তাই সব সময় করেছি। আমার পার্টির সঙ্গে সে জড়িত ছিল ঠিক কথা; কিন্তু কোনো দিন তাকে কোনো বিপদের মধ্যে জড়াইনি। ঐদিন পিস্তলটা ওকে আমিই দিয়েছিলাম আত্মরক্ষা করার জন্য। এভাবে যে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনা করিনি। অবশ্য এজন্য আমি খুবই দুঃখিত।
টিকলী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের সব কথা জানেন?
এমন সময় বুয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলে সাগর বলল, বলছি। আগে নাস্তা খেয়ে নিন।
টিকলী বলল, মাফ করুন সাগর ভাই, এখন আমার পেটে কিছু যাবে না। অন্য। দিন এসে খাব। প্লীজ, কিছু মনে করবেন না।
সাগর বুয়াকে বলল, এগুলো নিয়ে যাও। বুয়া চলে যাওয়ার পর বলল, আপনাদের সব কথা আমি জানি। ও রাজশাহীতে গিয়েছিল আপনাকে বিয়ে করার জন্য। আপনি ফিরিয়ে দিয়ে খুব ভুল করেছেন। ভার্সিটির ঘটনাটা তেমন কিছু না। ওর এই পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী। আপনাকে ও ভীষণ ভালবাসে। তাই আপনি ফিরিয়ে দিতে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে হিরোইনে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
টিকলী চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, যা বলছি সত্য। ব্যাপারটা জেনে আমিও খুব মর্মাহত। কিছুক্ষন আগে আমার কাছে দুহাজার টাকা চাইতে এসেছিল, হিরোইন খাওয়ার বিল শোধ করার জন্য। আমি দিইনি। বলেছি হিরোইন ছেড়ে দিলে দুহাজার কেন পাঁচ দশ হাজার টাকা তোকে দেব। তাই রাগ করে চলে গেল। তাকে ভালো হওয়ার জন্য অনেক বুঝিছি; কিন্তু কোন কাজ হয়নি।