তিনমাস পরে যেদিন টোপর ছাড়া পেল, সেদিন কাহহার সাহেব ও শাফিয়া বেগম। তাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে এলেন। টোপর কারো সঙ্গে কথা বলল না। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে মায়ের কাছ থেকে যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল, তা থেকে রাজশাহী যাতায়াত বাবদ পাঁচ-ছশো টাকা খরচ হয়েছিল। বাকি টাকা তার রুমে ছিল। সেই টাকা থেকে প্রতিদিন হিরোইনের নেশা করতে লাগল। ভার্সিটিতে যাওয়ার। নাম করে সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাসায় ফেরে। এভাবে কিছু দিন চলার পর টাকা ফুরিয়ে যেতে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে লাগল।
টোপর আগে টাকা নিলেও এত ঘন ঘন নিত না। জিজ্ঞেস করলে যদি সৎ মায়ের। তুলনা দেয়, তাই শাফিয়া বেগম একরকম বাধ্য হয়ে দেন।
জেলে থাকার সময় টোপর আসলামকে বলেছিল, সে যখন ছাড়া পাবে তখন হিরোইনের সব টাকা দিয়ে দেবে। তাকে বাসার ঠিকানাও দিয়েছিল।
ছয়মাস পর আসলাম ছাড়া পেয়ে একদিন তাদের বাসায় এসে টাকা চাইল।
টোপর আপ্যায়ন করিয়ে বলল, আপনার ঠিকানা দিন, গিয়ে দিয়ে আসব।
আসলাম ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, দুদিন অপেক্ষা করব; না পেলে এখানে নিতে আসব।
শাফিয়া বেগম জেল থেকে আসার পর টোপরের পরিবর্তন দেখে সন্দেহ করেছিলেন, সে জেলে খারাপ লোকের সংস্পর্শে খারাপ হয়ে গেছে। আজ আয়া যখন তার এক বন্ধু এসেছে বলে নাস্তার কথা বলল, তখন তার হাতে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়ে কেমন বন্ধু দেখার জন্য ড্রইংরুমের দরজার পর্দা ফাঁক করে তাদের কথাবার্তা শুনে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হল। বন্ধুটা চলে যাওয়ার পর ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?
আমার বন্ধু।
কেন এসেছিল?
ওর কাছে একবার কিছু টাকা নিয়েছিলাম, চাইতে এসেছিল।
কত টাকা?
আসলাম হিসাব দিয়েছিল দুহাজার। টোপর বেশি করে বলল, পাঁচ হাজার।
শাফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কেন নিয়েছিলি? তুই তো ইচ্ছা মতো আমার কাছ থেকে টাকা নিস।
টোপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, অনেক আগে কিসের জন্য যেন নিয়েছিলাম। তুমি আজ টাকাটা দাও, ওকে দিয়ে আসতে হবে।
শাফিয়া বেগম রেগে উঠে বললেন, তুই যে পানির মতো টাকা খরচ করছিস, একটু চিন্তা করে দেখছিস, টাকাটা আসে কোথা থেকে? তোর বাবা দিন রাত পরিশ্রম করছে। আর তুই দরকারে অদরকারে ইচ্ছামতো খরচ করছিস। আমার কাছে যা ছিল, এতদিন তোকে দিয়েছি। আর নেই, দিতে পারব না। তোর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিস। তোর ঐ বন্ধুকে দেখে ভালো বলে মনে হল না। তুইও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস।
টোপর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, টাকাটা ওকে দুএক দিনের মধ্যে দিতে হবে। তুমি বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দিও।
শাফিয়া বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমি পারব না। তোর দরকার, তুই চেয়ে নিস। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।
টোপর চিন্তা করল, দুহাজার টাকা যেমন করে হোক জোগাড় করতেই হবে। তা না হলে আসলামের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ছয় মাস হয়ে গেল জেল থেকে বেরিয়েছে, রাগে ও অভিমানে সাগরের সঙ্গে দেখা করেনি। ভাবল, ওর কাছ থেকে দু হাজার টাকা নিয়ে আসলামকে দিবে। সাগরকে দুএকমাস পরে ফেরৎ দেওয়ার কথা বলা যাবে। এই ভেবে সাগরের বাসায় যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখন সে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে বাসাতেই মিটিং করছিল। টোপরকে দেখতে পেয়ে ঈশারা করে বসতে বলল।
মিটিং শেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে সাগর টোপরকে বলল, কি খবর? এতদিন পর। এলি যে? ভার্সিটিতে খোঁজ করেও তোকে পাওয়া যায় না। পড়াশোনা ছেড়ে দিলি নাকি?
টোপর বলল, হ্যাঁ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। তা তুইও তো কোন খোঁজ খবর নিসনি?
খোঁজ খবর যে নিই নি তা নয়। বললাম না, ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়েছি। না পেয়ে তোদের বাসায় একজনকে পাঠিয়েছিলাম। তোর বাবা বললেন, তুই ভার্সিটি গেছিস। তা পড়াশোনা ছেড়ে দিলি কেন?
সে কথা পরে বলব। একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি।
বল কি দরকার?
হাজার দুই টাকার খুব দরকার। কিছু দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।
তোর বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। আমার কাছে টাকা চাইছিস, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বাবার টাকা তো আমার টাকা না যে, ইচ্ছা মতো খরচ করব।
তা হলে আমার টাকা দিবি কোথা থেকে?
সে ম্যানেজ করে দেব। আজ কালের মধ্যে দরকার। তাই তোর কাছে এলাম। দিবি কিনা বল।
সাগর পার্টির একটা ছেলেকে টোপরের খোঁজ নিতে বলেছিল। সে কয়েক দিন ফলো করে টোপর হিরোইন ধরেছে জানতে পেরে সাগরকে জানায়। তাই টাকা চাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে বলল, দেব, তবে কি দরকার না বললে দেব না।
একজন পাবে, সে খুব তাগিদ দিচ্ছে। তাকে দিতে হবে।
নিশ্চয় তাকেও কিছুদিন পর দিবি বলে নিয়েছিল? তাকে যখন দিতে পারিসনি, তখন আমাকে দিবি কি করে?
সাগর, মাত্র দুহাজার টাকার জন্য তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস?
হা করছি। কারণ তুই টাকাটা কখনো দিতে পারবি না। তবে টাকাটা কার কাছ থেকে কেন নিয়েছিলি বললে দিতে পারি।
তোকে আর দিতে হবে না বলে টোপর চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল।
আরে বস বস, যারা হিরোইনের নেশা করে তাদেরকে কেউ টাকা দেয় না।
টোপর চমকে উঠে বলল, তোকে একথা কে বলল?
যেই বলুক, কথাটা অস্বীকার করতে পারবি? পারবি না। তোর চেহারা, চোখ, মুখ তার প্রমাণ করছে। শোন, অন্য কোন কারণে যদি টাকা চাইতিস, তা হলে দুহাজার কেন, পাঁচ দশ হাজারও দিতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু হিরোইনের জন্য এক টাকাও দেব না। ছিঃ ছিঃ, তুই এই জঘন্য পথে পা বাড়ালি? জানিস না এর পরিণতি মৃত্যু? তোকে থানা থেকে ছাড়াইনি বলে তুই যে আমার উপর মনে কষ্ট পেয়েছিস এবং সেই কারণে জেলে দেখা করতে গেলেও দেখা করিসনি এবং জেল থেকে বেরিয়ে এতদিন আমার কাছে আসিসনি, তা আমি জানি। বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, সে সময় তোর বাবাকে বলেছিলাম, আমার পক্ষে এক লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি পঁচিশ হাজার দিচ্ছি, বাকিটা আপনি ম্যানেজ করুন। তোর বাবা বললেন, তোমার জন্যই আমার ছেলের এই পরিণতি। তারপর আরো অনেক কিছু বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। যাক সেসব কথা, এখন যা বলছি শোন, টাকাটা আমি তোর হাতে দেব না। আমাকে নিয়ে চল, আমি পাওনাদারকে দেব। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তাই বলছি তুই হিরোইনের নেশা ছেড়ে দে। এ ব্যাপারে আমি তোকে সাহায্য করব। তা তোর টিকলীর খবর কি?