প্রিয়তম টোপর,
হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা পাঠালাম, গ্রহণ করে ধন্য করো। সেদিন তুমি রাগ করে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে অন্তরজ্বালায় জ্বলছি, তা কবে নিভবে জানি না। তুমি হয়তো মনে করেছ, আমি তোমার সঙ্গে বেঈমানী করেছি। এটা সত্য কিনা উপরের মালিক জানেন। তুমি আগেও যেমন আমার মন প্রাণ জুড়ে ছিলে, এখনো তেমনি আছ এবং আমৃত্যু পর্যন্তও থাকবে। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কোনো ছেলের কথা ভাবা তো দূরের কথা, প্রয়োজন ছাড়া কারো দিক মুখ তুলে তাকাইনি। মায়ের কাছে ওয়াদা না করলে তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দিতাম না। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কারণ আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তোমাকে ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস তুমিও আমাকে একইরকম ভালবাস এবং আমাকে ছাড়া তুমিও বাঁচবে না। সেই বিম্বাসের জোরে আমি ক্ষমা চাইছি। আশা করি তা পাব। আবার বলছি তুমি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করো না, পার্টির কাজও। করো না। ওসব বাদ দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বেশি কিছু লিখে তোমাকে বিরক্ত করব না। চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবে। আর কবে আসবে জানাবে।
আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে আর একবার হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা জানিয়ে ইতি টানলাম।
তোমার প্রিয়তমা
টিকলী
লেখা শেষ করে দুটো চিঠি একসঙ্গে একটা খামে ভরে পোস্ট করে দিল।
জিনিয়া যেদিন চিঠি পেল সেদিন ভার্সিটিতে গোলমাল হয়ে টোপর এ্যারেস্ট হয়েছে। পরের দিন কাগজে অন্যান্যদের সঙ্গে তার ছবি দেখে ও ঘটনা পড়ে যেমন অবাক হল, তেমনি দুঃখও পেল। ভাবল, টিকলীও নিশ্চয় কাগজে খবরটা পড়েছে। কয়েক দিন অপেক্ষা করা যাক। টোপর ভাইকে নিশ্চয় তার বাবা থানা থেকে ছাড়িয়ে আনবেন। তারপর তাকে চিঠি দেবে।
হালিম সাহেব কাগজে টোপরের কির্তীকলাপের কথা পড়ে স্ত্রীকে ডেকে কাগজে ছবি ও লেখাটা দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখ।
সাজেদা বেগম পড়ে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, ভাগ্যিস আমি গিয়ে টিকলীকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলাম। নচেৎ সর্বনাশ হয়ে যেত। শুনেছিলাম, কাহহার সাহেবের ছেলেটা ভালো ছাত্র। এটাই বুঝি তার প্রমাণ। তারপর বললেন, আল্লাহ যা করেন সবার ভালর জন্যই করেন। এবার টিকলীর ভুল ভাঙ্গবে।
টিকলী খবরটা পড়ে খুব দুঃখ পেলেও বিশ্বাস করল না। ভাবল, মিছিলে ছিল বলে আহত হয়ে এ্যারেস্ট হয়েছে। তার বাবা ছাড়িয়ে নেবে। মনে হয় চিঠিটা পাইনি। পেলে নিশ্চয় মিছিলে যেত না। জিনিয়া নিশ্চয় চিঠি দিয়ে সব কিছু জানাবে। এইসব চিন্তা করে তার চিঠির অপেক্ষায় রইল।
বেশ কিছু দিনের জন্য ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে। টোপরকে চিঠি দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলি জিনিয়ার ধারে কাছে আসে না। জিনিয়া ভার্সিটিতে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু আলি তাকে পাত্তা না দিয়ে সরে গেছে। আজ থাকতে না পেরে জিনিয়া আলিদের বাসায় এল।
সাজেদা বেগম ছাড়া বাসায় কেউ নেই। হালিম সাহেব অফিসে চলে গেছেন। আলি বেশ কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। সাজেদা বেগম জিনিয়াকে দেখে হাসিমুখে বললেন, বান্ধবী নেই বলে আসতে নেই বুঝি?
জিনিয়া সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, বাবা একা একা কোথাও যেতে দেন। আজ বাবাকে এখানে আসার কথা বলে গাড়ি নিয়ে এসেছি। টিকলীর চিঠি পেয়েছেন? ও কেমন আছে?
সাজেদা বেগম বললেন, চিঠি দেয় না। দুএকদিন ছাড়া ফোন করে। কালও করেছিল, ভালো আছে।
জিনিয়া আলির কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পেল। তাই বলল, খালুজান বুঝি অফিসে গেছেন?
হ্যাঁ মা, আলিও নেই। বেশ কিছুক্ষণ হল বাইরে গেছে।
এখন আসি খালাআম্মা।
ওমা সেকি? আসতে না আসতে যাবে কি? বস, নাস্তা খেয়ে যাবে।
না খালাআম্মা, নাস্তা খেয়ে এসেছি।
খেয়ে এসেছ তো কি হয়েছে? খালাআম্মার কাছে এসে শুধু মুখে ফিরে যেতে নাই। এমন সময় আলিকে আসতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, টিকলী নেই বলে জিনিয়া এতদিন পরে এল। এখন আবার কিছু না খেয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। তুই ওর সঙ্গে গল্প কর, আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
জিনিয়া সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
আলি গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিয়ে একটা সোফায় বসল।
জিনিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কেমন আছ বললে না যে?
আমার ভালো মন্দ জেনে আর কি হবে? টোপরের তিন মাসের জেল হয়েছে। শুনেছ?
জিনিয়া চমকে উঠে বলল, না শুনিনি।
কি ব্যাপার চমকে উঠলে যে? মনে হচ্ছে টোপরের কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছ?
তা পেয়েছি, তবে তুমি যা ভাবছ তা সত্য নয়। আচ্ছা, তুমি আমাকে এত নীচ ভাবতে পারলে কি করে? একটা কথা মনে রেখ, সেই ক্লাস নাইন থেকে তুমি আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসে আছ। সেখানে আর কারো স্থান নেই। সেদিন টোপরকে যে চিঠিটা দিতে দেখেছ, সেটা আমার নয়। অন্য একটা মেয়ের। তারপরও তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে?
আলি চিন্তা করল, টোপর কি তা হলে টিকলীকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বলল, তাই যদি হয়, তা হলে মেয়েটির পরিচয় বল।
সে কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
আমি কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে সবকিছু গোপন রাখব।