জিনিয়া বসে বলল, ধন্যবাদ। তারপর বলল, আপনার বিরুদ্ধে দুটো নালিশ আছে।
আলী বেশ অবাক হয়ে বলল, নালিশ?
হা নালিশ। প্রথমটা হল, আমি আপনার ছোট বোনের বান্ধবী তবু আপনি করে বলেন। দ্বিতীয়টা হল, আপনি আমাকে খুব এড়িয়ে চলেন।
আলী কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জিনিয়া বলল, কিছু বলছেন না যে?
আলী বুঝতে পারল, টিকলী নিশ্চয় আমার কথা ওকে বলেছে। আর আজ সেই-ই একে পাঠিয়েছে। বলল, ঠিক আছে, এবার থেকে তুমি করে বলব। তারপর কবিতাটা একটা বইয়ের ভিতর থেকে বার করে এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এবার থেকে এড়িয়ে চলব না বলে এটা লিখেছি।
জিনিয়া ভাবল, নিশ্চয় এটা প্রেমপত্র। আনন্দে কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, এখনই পড়তে পারি?
পার।
কবিতাটা পড়তে পড়তে জিনিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। আনন্দে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
তাই দেখে আলী ভয় পেয়ে বলল, কি হল কাঁপছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
জিনিয়া সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি আমাকে এত ভালবাস, এযে আমি ভাবতেই পারছি না। আনন্দের চোটে তার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, অসাবধানে তুমি করে বলে ফেললাম। মাফ করে দিন।
আলী আলহামদুলিল্লাহ বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, চেয়ারে বস।
বসার পর বলল, মাফ চাইছ কেন? এটাই তো স্বাভাবিক। এবার থেকে তুমি করেই বলবে।
এরপর থেকে তাদের বিভিন্ন পার্কে অভিসার চলতে থাকে। জিনিয়া আলীকে মাঝে। মাঝে বাসায় নিয়ে আসে। মা বাবাকে যা জানাবার জানিয়েছে। মোয়াজ্জাম সাহেব ও মোকাররমা বেগম আলীর বাবার সঙ্গে দেখা করে কাবিন করে রাখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জিনিয়া তা করতে দেয়নি। বলেছে, আগে আলী পড়াশোনা শেষ করুক তারপর।
এই ঘটনা এক বছর আগের। এর মধ্যে আলী ও জিনিয়ার সম্পর্ক আরো অনেক গম্ভীর হয়েছে।
যেদিন জিনিয়া ভার্সিটিতে টিকলীর চিঠি টোপরকে দেয়, সেদিন দূর থেকে হঠাৎ আলীর নজরে পড়ে। টোপর চলে যাওয়ার পর আলী জিনিয়ার কাছে এসে বলল, টোপরকে কি যেন দিলে দেখলাম।
জিনিয়া মৃদু হেসে বলল, চিঠি দিলাম।
আলী চমকে উঠে বলল, চিঠি?
হ্যাঁ চিঠি। একজন দিতে দিয়েছিল।
একজনটা কে শুনি?
বলা যাবে না।
কেন?
তাও বলা যাবে না।
এমনি টোপরকে চিঠি দিতে দেখে আলীর জেলাস হয়েছিল। এখন জিনিয়াকে টাল বাহানা করতে দেখে সন্দেহ হল। বলল, না বললে, মাইন্ড করব কিন্তু।
দুঃখিত, তবু বলতে পারব না।
আলীর সন্দেহটা আরো দৃঢ় হল। একটু রাগের সংগে বলল, মনীষীরা যে বলেছেন, নারীরা ছলনাময়ী, তার প্রমাণ পেলাম।
জিনিয়া আহত স্বরে বলল, মনীষীদের কথা সব নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়।
তা হয় তো হবে, তবে তুমিই তো তার প্রমাণ দেখালে।
জিনিয়ার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছ?
আগে করতাম না, এখন করতে বাধ্য হলাম।
সামান্য একটা চিঠির জন্য তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে? স্কুল জীবন থেকে যাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি, যার জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, সে কিনা এই সামান্য কারণে আমাকে অবিশ্বাস করল। আল্লাগো এ কথা জানার আগে আমার মৃত্যু দিলে না কেন? কথা শেষ করে জিনিয়া চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল। আলী তার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল, টোপর ছোটবেলা থেকে টিকলীকে ভালবাসে। এখন আবার জিনিয়ার সঙ্গে কি ভালবাসায় মেতেছে? কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না। তবু সিদ্ধান্ত নিল, প্রথমে চিঠির রহস্য উদঘাটন করবে, তারপর জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করবে।
৬. রাগ ও অভিমান
টিকলীর উপর প্রচন্ড রাগ ও অভিমান করে টোপর সেই দিন রাতেই নাইট কোচে ঢাকা রওয়ানা দিয়ে পরের দিন বেলা দশটায় বাসায় পৌঁছাল।
শাফিয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত শিগ্রী ফিরে এলি যে? তারপর তার মুখের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, অসুখ বিসুখ করেনি তো?
টোপর ফেরার পথে চিন্তা করেছে টিকলীর চিঠিটা যদি মা বাবা তার মা-বাবার কাছে না দিত, তা হলে টিকলীর মা রাজশাহী যেত না, আর টিকলীও বিয়েতে অমত করত না। এই কথা ভেবে টিকলীর চেয়ে নিজের মা বাবার উপর রাগটা বেশি হল। তাই এখন মায়ের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ল। বলল, টিকলীর চিঠি তোমরা আমাকে দিয়ে তার মা-বাবাকে দিলে কেন?
শাফিয়া বেগম বললেন, তুই এসব কি বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
যা বলছি তা বুঝেও না বোঝার ভান করছ কেন? টিকলী রাজশাহী যাওয়ার আগে তাদের বুয়ার মেয়ের হাতে আমাকে দেওয়ার জন্য যে চিঠি দিয়েছিল, সেটা তোমরা নিয়ে আমাকে না দিয়ে তার মা-বাবার কাছে দিয়েছ, এ কথা অস্বীকার করতে পারবে?
তোকে একথা কে বলেছে?
কে আবার বলবে? আমি কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে রাজশাহী গিয়ে টিকলীর সাথে দেখা করেছি। বাবা না হয় রাগি মানুষ। কিন্তু তুমি জেনে শুনেও এমন কাজ করতে পারলে? এ জন্যেই বোধ হয় লোকে বলে, সৎ মা কখনো আপন মায়ের মতো হয় না।
শাফিয়া বেগম আহত স্বরে ভিজে গলায় বললেন, এমন কথা তুই বলতে পারলি? আমি কি তোকে সৎ ছেলের নজরে দেখি? তোকে নিজের পেটের ছেলেমেয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসি। যখন যা আবদার করেছিস, তোর বাবার বকুনী খেয়েও তা পূরণ করেছি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছলেন।