চিঠি পড়ে রহমান সাহেব শ্যালিকাকে বললেন, ছেলেটার পরিচয় বল।
সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর ছেলে। নাম হাসান। ডাক নাম টোপর। বি.এস.সিতে অনার্স নিয়ে মাষ্টার্স করছে।
তা হলে তো ভালই, তোমরা চাচ্ছ না কেন? ছেলেটা কি দেখতে শুনতে ভালো না, গরিবের ছেলে?
ওসব কিছু নয়।
তা হলে বাধা কোথায়?
আমরা যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছি। তার পাশের বাড়ির ছেলে। তার বাবা বাড়ি করার সময় থেকে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা।
তোমরা কি জান না, রাসুলুল্লাহ (দঃ) এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে শত্রুতা রাখতে নিষেধ করেছেন। আর প্রতিবেশীর সম্বন্ধে বলিয়াছেন, প্রতিবেশীর কি হক তাহা কি জান? সে তোমার সাহায্য চাহিলে তাহাকে অভয় দিবে, সে ঋণ চাহিলে তাহাকে ঋণ দিবে, সে নিঃস্ব হইলে তাহাকে দান করিবে, সে পিড়িত হইলে তাহার শুশ্রূষা করিবে, তাহার মৃত্যু হইলে জানাজাতে যোগ দিবে, তাহার সুসংবাদে সন্তোষ প্রকাশ করিবে, তোমার অট্টালিকা তাহার অনুমতি ব্যাতীত এত দূর উঁচু করিও না। যাহাতে বায়ু চলাচল বন্ধ হয় এবং তাহার কষ্ট হয়, তাহার বিপদে আপদে সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। যখন তুমি কোনো ফল ক্রয় কর তাহাকে কিছু দিবে, যদি না দাও তবে গোপনে তাহা ঘরে আনিবে এবং তোমার সন্তানগণ, তাহার সন্তানগণের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য যেন বাহিরে না আসে। [বর্ণনায় ও হ্যরত অমর (রাঃ) মেশকাত]
সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর সম্বন্ধের হাসিটা না জানলেও এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে যে শত্রুতা রাখতে নেই তা জানি। আপনার ভাইতো টোপরের বাবার সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেয়। কিন্তু লোকটা ভালভাবে সালামের উত্তরও দেন না। শুধু একটু মাথা নেড়ে দেন। ওদের বাসার কেউ নামায রোযাও করে না। আপনিই বলুন ওদের সঙ্গে কি আমরা সম্বন্ধ করতে পারি? সব থেকে বড় কথা টিকলী, এ বছর মেডিকেল ভর্তি হয়েছে। এখন ওর বিয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। ওর আব্বা তো চিঠি পড়ে রেগে আগুন। আমি অনেক বুঝিয়ে ঠান্ডা করে আপনাদের কাছে পরামর্শ করতে এসেছি।
রহমান সাহেব বললেন, আমার ধারণা ওদের ব্যাপারটা অনেক দিনের। তোমরা আগে টের পাও নি?
আপনার ধারণা ঠিক। ছেলে বেলায় ওরা এক সাথে স্কুলে যাতায়াত করত, খেলা ধুলা করত। তখন অতটা আমরা খেয়াল করিনি। চার পাঁচ বছর আগে টের পেয়ে টিকলিকে আমরা অনেক বুঝিয়েছি, শাসনও করেছি। তারপর থেকে ওরা চালাক হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে মেলামেশা না করে গোপনে করত। তখন আমরা মনে করেছিলাম, ওদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। এত বছর পর এই চিঠি পেয়ে জানতে পারলাম, ওরা তলে তলে ঠিকই মেলামেশা করেছে।
আচ্ছা, চিঠিটা তো টোপরকে দিয়েছে, তোমরা পেলে কি করে?
কি ভাবে পেলেন, সাজেদা বেগম খুলে বললেন।
রহমান সাহেব বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, চিঠির কথা ছেলেটা জানে না।
না, জানে না। তাইতো টিকলী ছেলেটাকে আবার চিঠি দেওয়ার আগেই এলাম আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।
রহমান সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমার মনে হয় ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে কোনো কাজ হবে না। তার চেয়ে তুমি একাকি টিকলীকে বুঝিয়ে বল, টোপর লেখাপড়া শেষ করে কিছু করুক। ততদিনে তুই ডাক্তারী পাশ করে ফেল। তারপর আমরাই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই যেমন পড়াশোনার ক্ষতি হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে।
সাজেদ বেগম বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমিও ঐ রকম ভেবেছি।
মাজেদা বেগম এতক্ষণ কোনো কথা বলেন নি। এবার সাজেদাকে উদ্দেশ্য করে। বললেন, ছেলের মা-বাবা কি বলেন?
সাজেদা বেগম বললেন, ছেলের মায়ের কথা বলতে পারব না। তিনি খুব ভালো। শিক্ষিতাও। ছেলের বাবা এমন অদ্র, স্ত্রীকে পাড়া প্রতিবেশীর বাসায় যেতে দেন না। তিনি এ ব্যাপারে ছেলেকে বলেই দিয়েছেন, টিকলীকে বিয়ে করলে ঘর থেকে বার করে দেবেন। চিঠিটা ছেলের বাবার হাতে পড়েছিল। তিনিই কাজের মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে কি লিখেছেন, তা তো পড়েছ।
রহমান সাহেব বললেন, আমি যা বললাম তাই কর। যদি ছেলেটা এখানে আসে, তা হলে যা বলার আমি তাকে বলব।
টিকলী রুমে এসে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু পরে আসার পর বলল, তোমরা কেন এসেছে বলত ভাইয়া। আম্মা যা বলল, তা আসল কারণ নয় বলে আমার মনে হচ্ছে।
আলী বলল, আম্মা তো আমাকে ঐ কথাই বলে নিয়ে এল। আসল কারণ আবার কি থাকবে? তারপর তার একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগল।
খাওয়া দাওয়ার পর সাজেদা বেগম মেয়ের রুমে এলেন।
মা ও ভাইয়ার আসার পর থেকে টিকলীর মনে হচ্ছে চিঠির কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এখন মাকে আসতে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, কিছু বলবে আম্মা?
সাজেদা বেগম বললেন, তুই এখানে আসার আগে যে চিঠিটা টোপরকে দিয়েছিলি, সেটা তার বাবার হাতে পড়ে। তিনি খুব রেগে গেছেন। তোর চিঠির সঙ্গে এটা লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা তার হাতে দিলেন।
টিকলী চিঠির কথা ভেবে এমনিই ভয় পেয়েছিল। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা পড়ে আরো বেশি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
সাজেদা বেগম বললেন, তোর বাবা কি রকম লোক তা তো জানিস। চিঠি পড়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছি। এখন যা বলছি শোন, তোদের ভালবাসায় বাধা দেব না। তবে এখন বিয়ের কথা একদম ভুলে যা। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তারীটা পাশ কর। টোপরও ততদিনে লেখাপড়া শেষ করে কিছু উপার্জন করুক। তারপর আমি তোর বাবাকে ম্যানেজ করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর তোর বাবা যদি একান্ত রাজি না হয় অথবা টোপরের মা-বাবাও যদি রাজি না হন, তা হলে তোরা নিজেরা নিজেদের কাজ সমাধান করবি। তখন টোপরের বাবা তোকে ঘরে না তুললেও তোদের ব্যবস্থা তোরা করে নিতে পারবি। তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, লক্ষী মা আমার, এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুই টোপরকে আমার কথাগুলো বুদ্ধি করে গুছিয়ে লিখে চিঠি দিয়ে জানা। সে তোকে যদি সত্যিকার ভালবেসে থাকে, তা হলে তোর চিঠি পেয়ে খুশি হবে। আর তা যদি না হয়, তা হলে বুঝবি তার ভালবাসায় খাদ আছে।