সামসুদ্দিন মিয়ার চার কামরা বাড়ির এক কামরায় স্বামী স্ত্রী থাকেন। একটা মেহমান এলে ব্যবহার হয়, এটা ভাড়ার ঘর আর একটায় বর্ষাকালের রান্নার জন্য জ্বালানী রাখেন। এবারে ঢাকা থেকে ফিরে এসে মেহমানদের কামরাটা রিয়াজুলের থাকার জন্য ঠিক-ঠাক করে রেখেছিলেন। সেখানেই তাকে থাকতে দেওয়া হল। খাওয়া-দাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে ভাইপোর রুমে এসে তার মা-বাবার কথা ও তাদের মারা যাওয়ার পর কিভাবে খালা খালুর ছেলে হল, সবকিছু বলতে লাগলেন :
রিয়াজুল বলল, কাল আম্মা-আব্বার কবর জিয়ারত করব।
সামসুদ্দিন মিয়া বলেন, ঠিক আছে যোহরের নামায পড়ে তোমাকে কবরস্থানে নিয়ে যাব। তারপর সম্পত্তি ভাগের কথা ও তার অংশের ফসল বিক্রির টাকা যে এত বছর ব্যাংকে জমা রেখেছেন সে কথা বলে বললেন, কালকেই তোমাকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে একাউন্ট খুলে সব টাকা তোমার নামে ট্রান্সফার করে দেব। আর একটা কথা, মোশারেফ হোসেনের পাঁচ বিঘে জমি ঐ টাকা থেকে তোমার নামে কিনেছি, কিন্তু তুমি না থাকাতে রেজিষ্ট্রি হয়নি। এবার করে নিতে হবে।
মোসারেফ হোসেনের নাম শুনে রিয়াজুলের আসমার কথা মনে পড়ল। তার বাবার নামও মোসারেফ হোসেন। বলল, তিনি এক সঙ্গে পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করলেন কেন?
সামসুদ্দিন মিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, সে অনেক কথা বাবা। সংক্ষেপে বলছি শোন, মোসারেফ হোসেন লোক হিসাবে খুব ভালো। তোমার আব্বার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। জমি জায়গা যা ছিল তার ফসলে বেশ ভালোভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বিধির বিধান কে খন্ডাবে। বড় ছেলেটা আই.এ. পাশ করে আদম ব্যাপারীর পাল্লায় পড়ে আর পড়ল না। কুয়েত যাওয়ার জন্য মা বাবাকে অস্থির করে তুলল। শেষে আড়াই বিঘা জমি বেচে তাকে কুয়েত পাঠালেন মোসারেফ হোসেন। আল্লাহর কি ইচ্ছা, সেখানকার আবহাওয়া সহ্য হল না ছেলেটার। যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সর্দি গরমে মারা গেল। এক সপ্তাহ পর লাশ ফিরে এল। ছেলের লাশ দেখে মোসারেফ হোসেন স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেলেন। চিকিৎসা করানোর জন্য আরো আড়াই বিঘা জমি বেচেছেন। এখন অল্প-সল্প কথা বলতে পারলেও হাঁটতে পারেন না। বড় মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল। বছর তিনেক আগে এস.এস.সি. পাশ করেছে। মোসারেফ হোসেন ভালো থাকলে এতদিনে বিয়ে দিয়ে দিতেন।
আসমার বাবার কথা শুনে রিয়াজুলের মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। বলল, আল্লাহর মহিমা বোঝা মানুষের অসাধ্য। তিনি মুহূর্তের মধ্যে মৃতকে জীবিত, জীবিতকে মৃত, ধনীকে গরিব ও গরিবকে ধনী করতে পারেন।
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, হ্যাঁ বাবা, তিনি সর্বশক্তিমান। যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
বড়চাচার ছেলে মেয়ে কয়জন তো বললেন না।
তিন ছেলে চার মেয়ে, সবার বিয়ে শাদি হয়ে গেছে।
ছেলেরা মসজিদে নামায পড়তে আসে না?
সব সময় না এলেও জুম্মার দিন আসে।
আচ্ছা ছোট চাচা, আমার কোনো ফুফু নেই?
হা একজন আছে। সে সবার ছোট নাম তানজিলা। প্রায় সাত মাইল দূরে তার বিয়ে হয়েছে। তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলে দুটো বড়। তোমার ফুফু, ফুপা ও তাদের ছেলে মেয়ের মাঝে মধ্যে এলে আমার কাছেই উঠে। বড় ভাইয়ের কাছেও থাকে, তবে আমার কাছেই বেশি থাকে।
আমি ফুফুদের বাড়ি বেড়াতে যাব।
নিশ্চয় যাবে বাবা, নিশ্চয় যাবে। তোমাকে দেখলে তানজিলা খুব খুশি হবে। এখানে যতবার আসে ততবারই আগে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।
ফুফা কি করেন?
গৃহস্থালী কাজ করেন। জমি-জায়গা অনেক।
আর ছেলে মেয়েরা।
সবাই পড়াশোনা করছে। জান বাবা, তোমার বড় চাচা তানজিলার নামও, রেকর্ড করাচ্ছেন না। আমি সে কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, তাকে এক জায়গা থেকে কিছু জমি দিয়ে দিলেই হবে। সব জায়গায় নাম লেখাবার দরকার নেই। পরে ঝামেলা হবে। আমি তোমার ফুফা আকবর হোসেনকে সেটেলমেন্ট অফিসের হাকিমের কাছে যেতে বলেছিলাম। সে বলল, গেলে মিয়া ভাই অপমানিত হবেন। তা ছাড়া আপনাদের বোনের সম্পত্তিতে আমার কোনো লোভ নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তানজিলা শুনে বলল, এখানে লোভের কথা আসবে কেন? এই সম্পত্তি আমার আল্লাহ প্রদত্ত হক। যে কেউ না-হক করতে চাইলে তার প্রতিবাদ করা উচিত। বড় ভাই যদি আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারেন, তা হলে আমরা প্রতিবাদ করতে পারব না কেন? আকবর হোসেন বললেন, তোমার কথা ঠিক, কিন্তু হাকিমের সামনে প্রতিবাদ করলে, ওঁর মান সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে। এটা আমি পারব না। তখন তোমার ফুফু আমাকে বলল, তুমি রিয়াজুলকে নিয়ে এস, তাকেও বড় ভাই ফাঁকি দিচ্ছে। রিয়াজুল আর আমাদের রফিক দু’জনে মিলে হাকিমের কাছে প্রতিবাদ করবে। তাই চিঠি দেওয়ার পরও তুমি যখন এলে না তখন আনতে গিয়েছিলাম।
রিয়াজুল হাই তুলে বলল, ফুফুআম্মা ঠিক কথা বলেছেন।
তাকে হাই তুলতে দেখে খায়রুন্নেসা স্বামীকে বললেন, এবার তোমাদের আলাপ বন্ধ কর। ছেলেটা কতদূর থেকে হয়রান হয়ে এসেছে। এবার ঘুমাতে দাও। তারপর রিয়াজুলকে বললেন, তোমার চাচা তোমাকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেছে।
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, হ্যাঁ বাবা, তোমার চাচি ঠিক কথা বলেছে। এবার ঘুমিয়ে পড়। তারপর পাশের রুম থেকে একটা চার্জ লাইট এনে বললেন, এটা মাথার কাছে রাখ। রাত এগারটার পর প্রতিদিন কারেন্ট চলে যায়। বাইরে যাওয়ার দরকার হলে এটা জ্বেলে যেও।