মুনসুর আলি বললেন, ও বড় হয়েছে, লেখাপড়া করেছে, নিজের ভালো মন্দ বোঝার জ্ঞানও হয়েছে। এটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করব না! আর ওর বাবার সম্পত্তির উপর আমাদের কোনো লোভ নেই। ও যদি বাবার সম্পত্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে তাতে যেমন বাধা দেব না, তেমনি চেষ্টা করতেও বলব না। তবে সে ব্যাপারে সাহায্য চাইলে পিছ-পা হব না। কারণ হককে যারা অন্যায় ভাবে না-হক করে, তারা জালেম। আর জালেমকে আল্লাহ ভাবাসেন না। এটা কোরআন পাকের কথা। আল্লাহর রাসুল (দঃ) মজলুমদের সাহায্য করতে বলেছেন।
সামসুদ্দিন বললেন, আমিও তা জানি। তাই তো রিয়াজুলকে সব রকমের সাহায্য করতে চাই। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো শিক্ষিত ছেলে, এতবড় জুলুম মেনে নেবে কেন?
রিয়াজুল মায়ের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কিছু বলছ না কেন?
জাহেদা সামসুদ্দিন মিয়ার যে কোন ছেলে মেয়ে নেই তা জানেন। ওঁর ধারণা সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে বাবার সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে রেখে দেবেন। তাই বললেন, তোর আব্বার ও চাচার সঙ্গে আমি একমত হলেও সম্পত্তি আদায় করতে গিয়ে তোর কোনো বিপদ হোক, তা আমি চাই না। জান্নাতবাসিনী মায়ের মুখে শুনেছিলাম, বিষয় সম্পত্তি বিষের মতো। সেই বিষের মোহ যেন তোকে পেয়ে না বসে। আর সে জন্যে তুই যদি সেখানে থেকে যাস এবং বিপদে পড়িস, তা হলে আমি বাঁচব না। তারপর চোখ মুছলেন।
রিয়াজুলকে দু’বছরের রেখে যখন তার মা মারা যান তখন সামসুদ্দিন মিয়ার ইচ্ছা ছিল, ভাইপোকে মানুষ করার। কিন্তু মেজ ভাবি রিয়াজুলকে তার বড় বোনের হাতে দিয়ে দেওয়ায় সে আশা পূরণ হয়নি। তবে একেবারে নিরাশ হননি। ভেবে রেখেছিলেন, উপযুক্ত বয়স হলে তার বাবার সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবেন। তাই এখন জাহেদার কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠলেন। সামলে নিয়ে বললেন, আপা কি যে বলেন, আমি থাকতে আল্লাহর রহমতে রিয়াজুলের কোনো বিপদ হতে দেব না। আর থেকে যাওয়ার কথা। যে বললেন, তা কী রিয়াজুলের মতো ছেলে পারবে? ওকে আপনারা শিশুকাল থেকে মানুষ করেছেন। আপনারাই ওর মা-বাবা। মা-বাবাকে ছেড়ে কোনো ছেলে কী চাচার কাছে থাকতে পারে? সম্পত্তির ব্যাপারে ও যা চাইবে তাই হবে। মা-বাবার কবর জিয়ারত করার কথা বলছিল, তাই এবারে না হয় আমার সঙ্গে গিয়ে দেশ দেখে এল। সেই সাথে মা-বাবার কবর জিয়ারতও করে এল।
রিয়াজুল চাচাকে বলল, আপনার সঙ্গে আমি যাব না। কিভাবে যেতে হবে বলুন, কয়েকদিন পরে যাব।
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, ঠিক আছে বাবা তাই যেও। তবে আমার সঙ্গে গেলে তোমার কোনো অসুবিধা হত না। তুমি তো কখনো গ্রামদেশে যাওনি, তাই সঙ্গে যেতে বলছিলাম।
রিয়াজুল বলল, মানুষ কত অজানা দেশে যাচ্ছে, এটা তো নিজের দেশ। অসুবিধা তেমন হবে কেন?
পরের দিন বাড়ি ফেরার সময় সামসুদ্দিন মিয়া কি ভাবে যেতে হবে রিয়াজুলকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলেন।
রিয়াজুল এক সপ্তাহ পরে আজ রওয়ানা হয়েছিল। আসমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। যখন ছোট চাচার বাড়িতে পৌঁছাল তখন তিনি সদরে বসে গরুর জন্য পাটের দড়ি পাকাচ্ছিলেন।
রিয়াজুলকে দেখে দড়িটা রেখে এগিয়ে এলেন।
রিয়াজুল সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
সামসুদ্দিন মিয়া সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আসতে কোনো অসুবিধা। হয়নি তো বাবা?
না চাচা কোনো অসুবিধা হয়নি। আপনারা কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তোমার আব্বা-আম্মা ভালো আছেন?
জ্বি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
চল বাবা ঘরে চল। তারপর তাকে নিয়ে উঠোনে এসে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কই গো, কোথায় গেলে? দেখবে এস কে এসেছে।
খায়রুন্নেসা স্বামীর কথা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিয়াজুলকে দেখে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
সামসুদ্দিন মিয়া হেসে উঠে বললেন, তুমি কাকে দেখে ঘোমটা দিচ্ছ? এতো আমাদের রিয়াজুল, মেজ ভাইয়ের ছেলে। যাকে নিয়ে আসার জন্য তুমি বারবার আমাকে বল।
রিয়াজুল বুঝতে পারল, ইনি ছোট চাচি। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কদম বুসি করল।
খায়রুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, থাক বাবা থাক, আল্লাহ তোমাকে সুখি করুন। এস বাবা ঘরে এসে বস। তারপর ঘরে এনে বসিয়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
কিছুক্ষণ পর আসরের আযান শুনে রিয়াজুল বলল, চলুন ছোট চাচা, মসজিদে নামায পড়তে যাই।
মসজিদে নামায পড়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া মুসুল্লীদের সঙ্গে রিয়াজুলের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
রিয়াজুল জিজ্ঞেস করল, বড় চাচা নামায পড়তে আসেননি?
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, সব সময় আসেন। আজ হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেননি। চল গ্রামের অন্যান্য সবাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সেই সাথে গ্রামটাও দেখা হয়ে যাবে।
মাগরিব ও এশার নামাযের সময়েও বড় ভাই মসজিদে এলেন না দেখে সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে বললেন, কাল সকালে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।
সামসুদ্দিন মিয়া বাপ-দাদার আমলের চার কামরা বাড়িতে আছেন। ভিন্ন হওয়ার পর নূরুদ্দিন মিয়া বাস্তুর অর্ধেক পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নতুন আট কামরা বাড়ি করেছেন। পাঁচিলের বাইরে সদর বাড়ি। মাতবর মানুষ, সারাদিন লোকজন যাতায়াত করে। তিনি সদর বাড়িতে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।