এতদিন বড় ভাই মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি ভোগ দখল করে এলেও সামসুদ্দিন কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু এবারে সেটেলমেন্টের মাপ শুরু হতে যখন মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি নিজের নামে লেখাতে শুরু করলেন তখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। একদিন তাকে বললেন, বড় ভাই, এটা কি ঠিক হচ্ছে? মেজ ভাই মারা গেলেও তার একটা ছেলে রয়েছে। সে এখন বড় হয়েছে। এবার তার বাবার সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। মেজ ভাইয়ের অংশের সম্পত্তি রিয়াজুলের নামেই রেকর্ড করান উচিত। তা না করে আপনি নিজের নামে করে নিচ্ছেন। লোকজন জানতে পারলে আপনার মান সম্মান থাকবে? তা ছাড়া কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কী জওয়াব দেবেন?
নূরুদ্দিন ছোট ভাইয়ের কথা শুনে খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমাদের পারিবারিক ব্যাপার লোকে জানবে কেন? আর জানলেও কারো ঘাড়ে দু’টো মাথা নেই যে, আমার বিরুদ্ধে কিছু বলবে। কেয়ামতের সময় আল্লাহকে যা বলার আমি বলব। তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার কাছে যে অংশ আছে ইচ্ছা করলে তার ছেলের নামে রেকর্ড করাতে পার। তুমি আর এব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলতে এস না।
সামসুদ্দিন ফিরে এসে একটা চিঠিতে বিস্তারিত লিখে জাহেদাকে জানাল, আপনি বলেছিলেন, রিয়াজুলের উপযুক্ত বয়স হলে তাকে তার আসল পরিচয় জানাবেন। সে এখন সাতাশ বছরের যুবক। আমার মনে হয় এখন জানাবার উপযুক্ত সময় হয়েছে। এবার তাকে সব কিছু জানিয়ে পাঠিয়ে দিন। আমি তাকে সবদিক থেকে সাহায্য করব।
চিঠি পেয়ে জাহেদা স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রিয়াজুলকে তার আসল পরিচয় ও তার বাবার সম্পত্তির কথা জানিয়ে সামসুদ্দিনের সাহায্য করার কথাও জানালেন।
রিয়াজুল এম.এ. পাশ করে চাকরীর চেষ্টা করছে। অনেক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, আমি তোমাদেরকে মা-বাবা বলে জানি। বাবা জন্মের আগে মারা গেছেন। মাও দু’বছরের রেখে মারা গেছেন। বড় চাচা বাবার সম্পত্তি মেরে খাচ্ছেন। ছোট চাচার যদি আমার প্রতি এত দয়া, তা হলে এতদিন প্রতিবাদ করেননি কেন? আমার কাছেই বা কেন পরিচয় গোপন করেছেন?
জাহেদা বললেন, তিনি গোপন করতে চাননি, আমিই তাকে বাধ্য করিয়েছি।
তাই যদি হয়, তা হলে এখন আমাকে এসব জানাবার দরকার কী ছিল? বাবার সম্পত্তি আমার দরকার নেই। আমি আপনাদের ছেলে। আমাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। আমার এখন কর্তব্য উপার্জন করে আপনাদের খেদমত করা।
মনসুর আলি বললেন, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ। আমাদেরও তোমার বাবার সম্পত্তির উপর কোনো লোভ নেই। আর এসব কথা তোমাকে কখনও জানাতামও না। তোমার মা তোমার ছোট চাচাকে কথা দিয়েছিল, উপযুক্ত বয়সে তোমাকে জানাবেন। তোমার ছোট চাচা চিঠিতে সেই ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে সম্পত্তির কথা জানিয়ে তোমাকে জানাতে বলেছেন এবং তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। আমরা আমাদের ওয়াদা পূরণ করার জন্য। সবকিছু তোমাকে জানালাম। এখন তোমার সবকিছু বোঝার মতো বয়স ও জ্ঞান হয়েছে। যা ভালো বুঝ করবে। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে, কয়েকদিন চিন্তা ভাবনা করে দেখি।
ঐদিন নামায পড়ে মোনাজাত করার সময় যখন বলল, রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা (হে প্রভূ আমার মাতা-পিতাকে রহম করুন, যেমন করে তাঁরা আমাকে শিশুকালে লালন-পালন করেছেন) [আল কোরআন, সূরা-বনি ইসরাইল, ২৪ আয়াত, পারা ১৫]। তখন রিয়াজুলের মনে মা-বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই অবস্থায় তাদের রুহের মাগফেরাতের জন্য আরো অনেক দোয়া করল। তারপর থেকে প্রায় হঠাৎ হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়তে লাগল। কয়েকদিন ভেবে ঠিক করল, বাবাকে তো দেখিনি, মাকেও না দেখার মতো। একবার অন্ততঃ দেশে গিয়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত করে আসবে।
চিঠি দিয়েও যখন রিয়াজুল এল না এবং কোনো উত্তরও পেল না তখন সামসুদ্দিন মিয়া একদিন ঢাকায় এলেন।
তখন রিয়াজুল বাসায় ছিল না দোকানে ছিল। জাহেদা ও মুনসুর আলি সালাম ও কুশল বিনিময় করে আপ্যায়ন করালেন।
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, আমার চিঠি নিশ্চয় আপনারা পেয়েছেন?
মুনসুর বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। পাওয়ার পর রিয়াজুলকে সবকিছু জানিয়েছি। সে কয়েকদিন ভাববার সময় নিয়েছে। তাই আপনাকে কিছু জানাতে পারিনি। বাসায় এলে আপনি তার সঙ্গে আলাপ করবেন।
মুনসুর আলি দোকানে গিয়ে রিয়াজুলকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় এস সামসুদ্দিন মিয়াকে দেখে সালাম বিনিময় করে কদমবুসি করল। তারপর জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, কয়েকদিন আগে মায়ের কাছে আমার আসল পরিচয় পেয়েছি। কিন্তু আপনি যে উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছেন, তা সম্ভব নয়। সম্পত্তির জন্য বড় চাচার সঙ্গে মনোমালিন্য করতে পারব না। তবে আব্বা আম্মার কবর জিয়ারত করার জন্য মাঝে মাঝে যাব।
সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, তাতো যাবেই। কিন্তু সম্পত্তির দাবি তুমি ছাড়বে কেন? এটা তোমার আল্লাহ প্রদত্ত হক। একজন অন্যায়ভাবে হককে না-হক করবে, তা তোমার মত শিক্ষিত ছেলের মেনে নেওয়া উচিত নয়। ঠিক আছে, দুলা ভাই আসুক, তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া সবাইকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য বসলেন, প্রথমে তিনিই মুনসুর আলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রিয়াজুল তো সম্পত্তির ব্যাপারে যেতে চাচ্ছে না। বড় চাচার সঙ্গে বিরোধ করতে পারবে না বলছে। তবে মাঝে মাঝে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে যাবে।