ইন্নালিল্লাহে………….রাজেউন পড়ে রিয়াজুল বলল, খুব দুঃখের ব্যাপার। আল্লাহ তোমার আব্বাকে সুস্থ করে দিন। তুমি সেয়ানা মেয়ে। বোরখা পরনি কেন? বোরখা পরলে এরকম বিপদে পড়তে না।
আমার বোরখা নেই। আম্মারটা পরার অযোগ্য। তাই চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওরা বাগানের ভিতর ফেলে দিয়েছে।
ওদেরকে তুমি চেন?
চেয়ারম্যানের ছেলে ইহসানকে চিনি। বাকি দু’জনকে চিনি না।
রিয়াজুলের মনে সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করল, ওতো এই গ্রামের ছেলে, চিনলে কেমন করে?
আসমা এই কথার উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগল।
আমার কথার উত্তর দিলে না যে?
আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার পিছনে লেগেছিল। সে আজ চার বছর আগের ঘটনা। এতদিন পরে আজ হঠাৎ যে এরকম করবে ভাবতে পারিনি।
তুমি একা একা গিয়েছিলে কেন? ছোট ভাইকে সঙ্গে নিতে পারতে।
ওর আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। খুব জরুরী কাজে আম্মা পাঠিয়েছিলেন। তারপর অনেক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কতদিন এখানে থাকবেন?
সে কথা আল্লাহ জানেন। তবে আপাতত বেশ কিছুদিন থাকব।
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। গ্রামে ঢুকে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে গেছে। সেখানে এসে আসমা বলল, আপনি তো মিয়াবাড়ি যাবেন?
হাঁ মিয়া বাড়ি কোন দিকে বল তো?
আসমা একটা রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, চলুন আমি দেখিয়ে দিয়ে আসি।
না না তোমাকে যেতে হবে না, আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যেতে পারব। তার চেয়ে আমাদের বাড়িতে চলুন। খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নেবেন। আব্বার সঙ্গে পরিচয়ও হবে। বিকেলে আমার ভাই আপনাকে পৌঁছে দেবে।
কথাটা মন্দ বলোনি, তবে তা সম্ভব নয়। আচ্ছা চলি একদিন এসে তোমার আব্বার সঙ্গে পরিচয় করব। কথা শেষ করে রিয়াজুল হাঁটতে শুরু করল।
আসমা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির দিকে। হাঁটতে লাগল।
৩-৪. মিয়াবাড়ির খুব নাম ডাক
জয়নগর গ্রামের মিয়াবাড়ির খুব নাম ডাক। খান্দানী বংশ। বিষয় সম্পত্তি প্রচুর। তিন ভাইয়ের বড় নূরুদ্দিন মিয়া ও ছোট সামসুদ্দিন মিয়া বেঁচে আছেন। মেজ সালাউদ্দিন মিয়া অনেক আগে মারা গেছেন। রিয়াজুল তারই ছেলে।
রিয়াজুল যখন তার মায়ের পেটে ছয় মাসের তখন সালাউদ্দিন মিয়া মারা যান। আর রিয়াজুলের বয়স যখন দুই বছর তখন তার মায়ের খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে অনেক দিন চিকিৎসা করান হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সেখানেই মারা যান। মারা যাওয়ার আগে বোন জাহেদার হাতে রিয়াজুলকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বুবু একে তোমাকে দিয়ে গেলাম। আজ থেকে তুমি ওর মা। তারপর দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আপনারা একে নিজেদের ছেলের মতো করে মানুষ করবেন। সেই থেকে রিয়াজুল খালা-খালুর কাছে মানুষ হয়েছে। তার বড় চাচা নুরুদ্দিন মিয়া গ্রামের। মাতবর। খুব কৃপণ ও লোভী। গরিবদের বিপদে আপদে সাহায্য করার সুযোগে তাদের। জমি-জায়গা হাতিয়ে নেন। নিয়মিত নামায রোযা করেন, হজ্বও করেছেন। কিন্তু আখলাকের পরিবর্তন তার হয়নি। সালাউদ্দিন ও ছোট সামসুদ্দিন বড় ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরিত। যেমন পরহেজগার তেমনি দিলদার। সামসুদ্দিনও হজ্ব করেছেন। সালাউদ্দিন কম বয়সে মারা গেছেন। তাই হজ্ব করতে পারেন নি। তিনি গরিবদের প্রতি খুব সদয় ছিলেন।
কেউ যে কোনো বিষয়ে সাহায্যপ্রার্থী হলে বিমুখ করতেন না। সামসুদ্দিন বড় ভাইকে ভক্তি শ্রদ্ধা করলেও তার কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নন। মাঝে মাঝে বড় ভাইয়ের ন্যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। ভিননা হওয়ার সময় মৃত মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ গোলমাল হয়। সামসুদ্দিন মিয়া চেয়েছিলেন, মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি বর্গা দিয়ে তার ফসল বিক্রি করে ভাইপো রিয়াজুলের খালা খালুকে দিতে; কিন্তু নুরুদ্দিন তাতে রাজি না হয়ে দু’ভাইয়ে ভাগ করে নেন। বছরের শেষে সামসুদ্দিন মেজ ভাইয়ের অংশের জমির ফসল ও ফল-মূল বিক্রি করে বড় ভাইকে বললেন, টাকাটা আমি রিয়াজুলের খালা-খালুকে দিতে যাব। আপনিও কি দেবেন?
নুরুদ্দিন রেগে উঠে বললেন, এ টাকা তাদেরকে দিতে হবে কেন? তারা তো খেয়ে পরে শেষ করে দেবে।
তা হলে টাকাটা কি করব?
সেটা তুমি জান? তবে তাদেরকে দিও না।
সামসুদ্দিন ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, প্রতিবছর টাকাটা ব্যাংকে রাখবেন। রিয়াজুল উপযুক্ত হলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন।
রিয়াজুলের বড় খালা জাহেদার বিয়ে ঢাকায় বেশ বড় ঘরেই হয়েছিল। তার খালু মুনসুর আলি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। চাচাদের সম্পত্তি নিয়ে মামলা করে সর্বসান্ত হয়েছেন। শুধু দাদার আমলের দোতলা চার কামরা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। গুলিস্তানে একটা ষ্টেশনারী দোকানের আয়ে সংসার চালান। তাদের কোনো সন্তানাদি হয়নি। রিয়াজুলকে পেয়ে আল্লাহর দান মনে করে মানুষ করেছেন। রিয়াজুল তাদেরকেই আপন মা-বাবা জানে। পড়াশোনার অবসরে বাবার দোকানে এসে বসে।
রিয়াজুলের ছোট চাচা সামসুদ্দিন বছরে দু’তিনবার ঢাকায় এসে ভাইপোকে দেখে। যেতেন। সেই সময় জাহেদ তাকে বলে দিয়েছিলেন, রিয়াজুলকে যেন তার আসল পরিচয় জানায়। উপযুক্ত বয়স হলে তিনি নিজেই জানাবেন। তাই আজ পর্যন্ত জানাননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রিয়াজুল জেনে এসেছে সামসুদ্দিন বাবার দূর সম্পর্কের ভাই।