রিয়াজুল তার জামার কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ছেলে। ছিঃ ছিঃ এরকম কাজ করা তোমাদের ঠিক হয়নি। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোন গ্রামের ছেলে?
ইহসান রাগে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু বসির ও সাগির খুব লজ্জা পেয়েছে। তারা আপন চাচাতো ভাই। তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। বন্ধুকে শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বসির বলল, আমরা এই গ্রামেরই ছেলে।
তোমার নাম কি?
বসির।
তামার বাবার নাম?
জাফর আলি।
রিয়াজুল সাগিরকে জিজ্ঞেস করল তোমার নাম?
সাগিব।
বাবার নাম?
সানোয়ার আলি।
রিয়াজুল এবার ইহসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম?
ইহসান উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
বসির বলল, ও চেয়ারম্যান আলি আসগরের ছেলে ইহসান।
তোমরা কি পড়াশোনা কর?
এস.এস.সি. পরীক্ষায় ফেল করে আর পড়িনি।
এটা তোমরা খুব ভুল করেছ। আমি তোমাদের বড় ভাইয়ের মতো। তাই কয়েকটা কথা বলছি শোন, তোমাদের কারো বোনকে যদি কেউ এরকম করত, তা হলে তোমরা কি করতে? নিশ্চয় তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে শালীসি ডাকতে। এখন ভেবে দেখ, তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছিলে, তা ক্ষমার অযোগ্য। তোমাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। বড় ভাই হিসাবে আজ তোমাদের ক্ষমা করে দেব, যদি তোমরা ভবিষ্যতে এরকম আর করবে না বলে প্রতিজ্ঞা কর। নচেৎ তোমাদের গার্জেনদের জানিয়ে এর বিহীত করব।
এই কথায় বসির ও সাগির খুব ভয় পেল। কারণ তাদের বাবা খুব কড়া লোক। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, এরকম কাজ আর জীবনে করব না।
ইহসানকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়াজুল বলল, কী ভাই তুমি কিছু বলছ না কেন? মনে হচ্ছে আমার উপর খুব রেগে আছ?
এমন সময় চেয়ারম্যান আলি আসগরকে দু’জন লোকের সঙ্গে আসতে দেখে বসির বলে উঠল, ইহসান তোর আব্বা আসছে।
সেদিকে তাকিয়ে ইহসানের মুখে রাগের পরবর্তে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। ভাবল, আব্বাকে যদি লোকটা বলে দেয় তা হলে আস্ত রাখবে না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর কোনোদিন এমন কাজ করব না।
রিয়াজুল বলল, পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। মনে রেখ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে, আমি জানতে পারব। তখন কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না। তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
আসমা।
বাড়ি?
আসমা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ গ্রামের পাশের গ্রাম জয়নগরে।
আরে আমারও তো ঐ গ্রামেই বাড়ি। তোমার বাবার নাম কি?
মোসারেফ হোসেন।
ততক্ষণে আলি আসগর দু’জন সঙ্গিসহ সেখানে এসে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী ব্যাপার এখানে কি করছ?
ইহসান কিছু বলার আগে রিয়াজুল সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন চেয়ারম্যান চাচা?
আলি আসগর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।
আমি জয়নগর গ্রামের মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করি। গ্রামে তো থাকি না, চিনবেন কি করে?
আলি আসগর বেশ অবাক হয়ে বললেন, তুমি সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে?
জ্বি।
আল্লাহ তোমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করুন। খুব ভালো লোক ছিলেন। শুনেছি, তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে তখন তিনি মারা যান। তা হঠাৎ কি মনে করে এলে? এবার দেশে থাকবে নাকি? তোমার ছোট চাচার সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। তার কাছে। শুনলাম, তোমার বাবার সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল চলছে।
জ্বি সেই জন্যেই তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।
আলি আসগর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে যেন চেনা চেনা লাগছে, কার মেয়ে তুমি?
আসমা বলল, জয়নগর গ্রামের মোসারেফ হোসেনের মেয়ে।
আহা রে! তোমার বাবাও খুব ভালো লোক। ছেলের কারণে পঙ্গু হয়ে গেল। তা তোমার বাবা কেমন আছে?
জ্বি ঐ একই রকম।
ইহসান, বসির ও সাগির এক ফাঁকে সেখান থেকে কেটে পড়ছে। রিয়াজুল বলল, চাচা, আমরা এবার যাই?
হ্যাঁ যাও, বলে আলি আসগর সঙ্গিদেরকে বললেন, চল।
কিছুটা আসার পর রিয়াজুল আসমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কেন এসেছিলে?
আসিনি, বালিয়াকান্দি মামাদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম।
লেখাপড়া কতদূর করেছ?
তিন বছর আগে এস.এস.সি. পাশ করেছি।
তাই নাকি? তা হলে তো তুমি করে বলে ভুল করেছি। যাক কিছু মনে করবেন না। না জেনে…………।
কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে আসমা পথ রোধ করে কদমবুসি করে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, আমি আপনার পায়ের ধূলোর যোগ্যও নই। আমাকে তুমি করেই বলবেন। আপনি আমার ইজ্জত বাঁচিয়ে নবজন্ম দিয়েছেন। ঠিক সময় মতো এসে না পড়লে কি যে হতো আল্লাহকেই মালুম। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
রিয়াজুল তাকে কিছুক্ষণ কাদার সময় দিয়ে বলল, হ্যাঁ এটাই আল্লাহ পাকের ইশারা ছিল। এবার চল যেতে যেতে কথা বলি। তারপর যেতে জিজ্ঞেস করল, তোমার কে কে আছে?
আম্মা- আব্বা ও এক ভাই এক বোন। ওরা সবাই আমার ছোট।
তোমার আব্বার নাম যেন তখন কি বললে?
মোসারেফ হোসেন।
চেয়ারম্যান চাচা তোমার আব্বার পঙ্গু হওয়ার কথা যেন কি বলছিলেন?
আমার একটা বড় ভাই ছিল, এইচ.এস.সি পাশ করে কুয়েতে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে সেখানে মারা যায়। লাশ ফিরে এলে আব্বা দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেছেন।