আসমা বসে বলল, হ্যাঁ, সবাই ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
ভালো, অনেক দিন আসনি কেন? আগে তো প্রায় আসতে।
কি করে আসব? কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দু’বেলা প্রাইভেট পড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া বুঝি মাঠে গেছে?
হ্যাঁ, হাল চাষ করতে গেছে।
রহিমকে দেখছিনা কেন?
তাকে এবারে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলে গেছে।
যাই, মেজ মামা ও ছোট মামাদের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ঠিক আছে এস।
খাওয়া দাওয়া করে টাকা নিয়ে আসমা বেলা দেড়টায় রওয়ানা দিল। মামা-মামি এত রোদে যেতে নিষেধ করে বিকেলে যেতে বলেছিলেন; আসমা শোনেনি। মাইল দুয়েক আসার পর দূর থেকে ইহসানকে দুটো ছেলের সঙ্গে তাদের বাগানের কাছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। সে যখন ক্লাস টেনে পড়ত তখন থেকে এস.এস.সি. পাশ করা পর্যন্ত ইহসান তার পেছনে লেগেছিল। প্রতিদিন স্কুলের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। ছুটির সময় পথে অনেকবার দেখা করে প্রেম নিবেদন করে চিঠিও দিয়েছে। আসমা উত্তর দেয়নি। শেষে চিঠি দিয়ে বিয়ে করার কথা বলেছিল। আসমা তারও উত্তর দেয়নি। একদিন একা পেয়ে কুৎসিৎ প্রস্তাব দিয়ে ভয়ও দেখিয়েছিল। আসমা রেগে গিয়ে বলেছিল, আমি স্যারকে বলে আপনার বাবার কাছে নালিশ করব। তারপর থেকে আর কাছে আসেনি, কথাও বলেনি। কিন্তু যাওয়া আসার পথে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সে সব চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে ইহসানের সঙ্গে আসমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আজ তাকে দেখে ভয় পেলেও ভাবল, এতদিনে হয়তো ইহসান তাকে ভুলে গেছে। বিয়ে শাদি করেছে। এখন ভয় পাওয়ার কি আছে ভেবে দ্রুত হাঁটতে লাগল। কাছাকাছি এসে না দেখার ভান করে যখন মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ইহসানের গলা শুনতে পেল, আসমা দাঁড়াও।
আসমা দাঁড়াল না, আরো দ্রুত হাঁটতে লাগল।
ইহসান প্রায় ছুটে এসে তার পথ রোধ করে বলল, তোমাকে ডাকলাম আর তুমি না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছ যে।
আসমা বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সঙ্গি দু’জন নেই। তবে অনেকটা দূরে একটা লোক এদিকে আসছে। চিন্তা করল, লোকটা কাছে আসা পর্যন্ত ইহসানকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
মিথ্যে করে বলল, আমি খুব অন্যমনষ্ক ছিলাম। আপনার কথা শুনতে পাইনি। কি বলবেন বলুন। আমার খুব তাড়া আছে।
ইহসান বলল, চার বছর আগে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়েছিলাম। তখন রেগে গেলেও ভেবেছিলাম, তুমি ম্যাচিওর হওনি। আজও তোমার ভালবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। এখন তুমি পূর্ণ ম্যাচিওর। আশা করি, আজ আর আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দেবে না।
এটা সম্ভব নয় ইহসান ভাই। আপনি বড় লোকের ছেলে। আপনার জন্য কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা হাঁ করে বসে আছে। আমার বাবা শুধু গরিব নয়, একেবারে সহায় সম্বলহীন। তা ছাড়া….।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইহসান বলে উঠল, প্রেম ভালবাসার কাছে ধনী গরিবের প্রশ্ন অবান্তর। তোমার কোনো কথাই শুনব না। আজ তোমাকে বলতেই হবে, তুমি আমাকে ভালবাসবে কিনা?
আপনি কি জানেন মুখে বললেই যেমন ভালবাসা হয় না, তেমনি জোর করেও তা পাওয়া যায় না।
ইহসান এতক্ষণ নরম ভাবে কথা বললেও এবার গরম মেজাজে বলল, তার মানে তুমি আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?
আসমা এতক্ষণ রেখে ঢেকে কথা বলছিল। আগন্তুক পথিক কাছে এসে গেছে দেখে সেও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ ফিরিয়ে দিচ্ছি। কারণ আপনার দুশ্চরিত্রের কথা জানতে আমার বাকি নেই। চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি, নচেৎ টের পেতেন।
ইহসান আসমাকে আসতে দেখে বন্ধু দু’জনকে বাগানের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলেছিল, আসমা যদি আমার কথায় রাজি না হয়, তা হলে বাগানের ভিতরে নিয়ে গিয়ে যা করার করে ওর অহঙ্কার ভাঙবো। এখন আসমার কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার একটা হাত ধরে বাগানের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
আসমার স্বাস্থ্য ভালো। গায়ে শক্তিও আছে। ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল।
ইহসান আসমাকে জাপটে ধরে বন্ধুদের বেরিয়ে আসতে বলল।
ইহসানের বন্ধু দু’জনের একজনের নাম বসির, অন্যজনের নাম সাগির। তারাও স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। তিনজনেই কয়েক বছর আগে এস.এস.সি. ফেল করার পর আর পড়েনি।
ইহসানের কথা শুনে বসির ও সাগির এসে তিনজনে মিলে আসমাকে বাগানের ভিতরে নিয়ে যেতে লাগল।
আসমা প্রাণপনে বাধা দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগল, কে কোথায় আছ বাঁচাও।
আসমা যে লোকটাকে দূর থেকে আসতে দেখেছে তার নাম রিয়াজুল। ততক্ষণে সে তাদের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। আসমার চিৎকার শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি তাদের পথ রোধ করে গম্ভীর স্বরে বলল, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।
এতক্ষণ তারা কেউ রিয়াজুলকে লক্ষ্য করেনি। তার কথা শুনে ইহসান বন্ধুদের বলল, শালাকে ভাগাবার চেষ্টা কর।
বসির ও সাগির রিয়াজুলের ষণ্ডা মার্কা চেহারা দেখে কিছু করার সাহস পেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
রিয়াজুল ইহসানের জামার পিছনের কলার ধরে কঠিন কণ্ঠে বলল, ভালো চাও তো ছেড়ে দাও।
ইহসান রিয়াজুলের গলার স্বর শুনে ও বন্ধুদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল। আসমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে করে নিল।