তাই নাকি? সত্যি রিয়াজুল ভাই খুব উঁচু মনের ছেলে। আমার এখন আরো দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে আমাদের ব্যাপারটা যদি জেনে থাকেন, তা হলে যা বললাম তা করবেনই।
আসমা বলল, আল্লাহ যেন তাই করেন। তুমি এবার যাও, আর রাত্রে এস না। দিনে সময় করে এস।
ঠিক আছে, তাই আসব বলে মতি বিদায় নিয়ে চলে গেল।
.
সালেহাকে পছন্দ হলেও রিয়াজুল মনোয়ার হোসেন চাচার প্রস্তাবটা এবং আসমা ও মতির সম্পর্কের কথা তিন চার দিন পার হয়ে গেলেও ছোট চাচাকে বলতে পারল না। শেষে মা-বাবাকে চিঠি লিখে সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় বিস্তারিত জানাল। আরো জানাল, তারা যেন অতি শিঘ্র এসে ছোট চাচাকে নিয়ে সমস্যা মিটিয়ে দেন।
দু’বছর আগে সালেহা নাইনে উঠে পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। রিয়াজুল তাকে এ বছর ঐ ক্লাসেই ভর্তি করে দিয়েছে। একদিন ছুটির সময় স্কুল থেকে ফেরার পথে সালেহার সঙ্গে দেখা করে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। কথাগুলো ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, কাউকে বলবে না, তবে তোমার বুবুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বলতে পার।
সালেহা বলল, আপনার যে কোনো কথা আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। তা ছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি কোনো মন্দ কথা বলতে পারেন না।
আমাকে এত বড় মনে করার কারণটা বল তো?
সূর্য কিরণ না দিলে পৃথিবী যেমন অন্ধকার হয়ে থাকত, চাঁদের আলো যদি না থাকত, তা হলে পৃথিবীর মানুষ যেমন সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হত, তেমনি যেসব মানুষ মানুষের উপকারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে, তারা চন্দ্র সূর্যের মত। আপনি তাদেরই একজন।
আমাকে অত বড় করে বলো না সালেহা। তুমি যাদের কথা বললে, তারা আল্লাহর খাস বান্দা। তাদের পায়ের ধূলোর যোগ্যও আমি নই।
আল্লাহর খাস বান্দারা নিজেদেরকে তাই মনে করেন। যাই হোক, কি বলবেন বলছিলেন বলুন।
তুমি কী তোমার বুবুর ও মতির সম্পর্কের কথা জান?
জ্বি জানি।
আমার সঙ্গে তোমার বুবুর বিয়ের কথা হয়েছে, তাও নিশ্চয় জান?
জ্বি জানি।
তোমার বুবু প্রতিবাদ করেনি কেন, বলতে পার?
জ্বি পারি। ডাক্তার বলেছেন, আব্বা কোনো কারণে উত্তেজিত হলে আবার পঙ্গু হয়ে যাবেন, তাই করেনি।
তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী ও স্পষ্টবাদিনী। বল তো দেখি। আমার এখন কী করা উচিত?
আমি সত্য জিনিস চেপে রাখতে পারি না। সে জন্য অনেকে আমাকে ঠোঁটকাটি বলে। কিন্তু বুদ্ধিমতী কেউ বলেনি। আপনার মুখে এই প্রথম শুনলাম।
সালেহার সঙ্গে রিয়াজুল যত কথা বলছে, তত তার সুপ্ত প্রতিভা জানতে পেরে মুগ্ধ হচ্ছে। ততক্ষণে তারা পুকুর পাড়ে চলে এসেছে। বলল, তোমার সঙ্গে আরো কিছু কথা আছে, ঐ জামরুল গাছের গোড়ায় বসি চল।
কেন, ঘরে চলুন না।
ঘরে পরে যাব, তার আগে কথাগুলো এখানে সেরে নিতে চাই।
সালেহা কিছু না না বলে জামরুল গাছের তলায় এসে ঘাসের উপর বসে বলল, এবার বলুন।
রিয়াজুল দূরত্ব বজায় রেখে বসে বলল, আমি যদি আগে তোমার বুবু ও মতির সম্পর্কের কথা জানতাম, তা হলে মা-বাবা ঢাকায় যখন আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন তখন। অমত করতাম। ঢাকা থেকে ফিরে মাত্র চার পাঁচ দিন আগে জেনে খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। আর ওরাও যে ভুগছে, তাও বুঝতে পারছি তোমার বাবার কথা চিন্তা করে এখন আমিও এ বিয়েতে অমত করতে পারছি না। এক এক সময় মনে হয় ঢাকার ছেলে ঢাকায় চলে যাই। কিন্তু ঐ একই কারণে যেতেও পারছি না। এই কঠিন সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় তোমার হাতে।
আমার হাতে? কী বলছেন আপনি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বলে সালেহা তার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
রিয়াজুলও কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ সালেহা, তুমিই পার তোমার বাবার জীবন রক্ষা করতে এবং তোমার বুবুকে, মতিকে ও আমাকে যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা করতে।
সালেহা আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, বেশ যদি তাই হয়, তা হলে ইনশাআল্লাহ আমার জীবনের বিনিময়েও তা করব। বলুন আমাকে কী করতে হবে?
তোমাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবে সেই উত্তরটা যেন তোমার মনের কথা হয়।
ভনিতা করে কিছু বলা যে হারাম, তা আমি জানি, আল্লাহর কোনো ঈমানদার বান্দা বান্দি জীবন গেলেও ভনিতার আশ্রয় নেয় না।
রিয়াজুল সুবহান আল্লাহ বলে বলল, তোমার কথা শুনে খুব খুশি হলাম। তারপর বলল, প্রথম যেদিন তোমাদের বাড়িতে আসি, সেদিন পুকুর ঘাটে তোমাকে দেখে ও তোমার সঙ্গে কথা বলে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, মনে মনে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য আল্লাহকে জানিয়ে ছিলাম। তাই তোমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করি। ঢাকাতে আসমাকে দেখে মা-বাবা যখন মতামত জানতে চাইল তখন তারা মনে কষ্ট পাবে ভেবে অমত করিনি। ভেবেছিলাম, আল্লাহ সালেহাকে আমার জোড়া করেননি, করেছেন আসমাকে। এখন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, আল্লাহ পাক সেই প্রথম দিন যে দোয়া করেছিলাম, তা কবুল করেছেন। কিন্তু কিভাবে কি করব ভেবে ঠিক করতে না পেরে মনোয়ার হোসেন চাচাকে তোমার বুবুর ও মতির সম্পর্কের কথা বলে আমার সমস্যার কথা বলি। তিনি বললেন, তুমি যদি সালেহাকে বিয়ে কর, আর আসমার বিয়ে মতির সঙ্গে দেওয়ার ব্যবস্থা কর, তা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাল রাতে আমি এস্তেখারার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলাম, আল্লাহ আমি যে সমস্যায় পড়েছি, তা থেকে তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দাও। তারপর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, আমি তোমাদের পুকুরে গোসল করার সময় সাঁতার কাটতে কাটতে যখন মাঝখানে গেছি তখন কে যেন পানির ভেতর থেকে আমার একটা পা ধরে টেনে আমাকে পানির নিচে নিয়ে যেতে লাগল। আমি অনেক চেষ্টা করেও ভেসে থাকতে পারলাম না, ডুবে গেলাম। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফট করছি, হঠাৎ মনে হল, কে একজন আমার একটা হাত ধরে পানির উপরে নিয়ে এসে সাঁতরিয়ে পুকুরের কিনারে নিয়ে এল। আমি তখন খুব ক্লান্ত। একটু পরে স্বস্তি বোধ করে উদ্ধার কর্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি। আর তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নটা দেখার পর ভেবে রাখলাম, তোমাকে আমার ইচ্ছার কথা জানাব, এখন আমি তোমার মতামত জানতে চাই।