জ্বি জানেন। এবার আসি। সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে রিয়াজুল আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, কী ভাবে মতির সঙ্গে আসমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে? সব থেকে বেশি যে কথাটা ভাবিয়ে তুলল, সেটা হল মোসারেফ চাচাকে কী করে ম্যানেজ করবে। আসমাকে বিয়ে করব না শুনে যদি মনে আঘাত পেয়ে স্ট্রোক করে আবার পঙ্গু হয়ে যান। সারাদিন চিন্তা করেও কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারল না। শেষে ভেবে রাখল, মনোয়ার হোসেন চাচাকে সব কথা জানিয়ে পরামর্শ চাইবে।
মোসারেফ হোসেন ঘরে এসে স্ত্রীকে, আসমাকে ও সালেহাকে ডেকে দলিলটা দেখিয়ে বললেন, এটা আমাদের পাঁচ বিঘা জমির দলিল। যে জমি আমি সামসুদ্দিন মিয়ার কাছে বিক্রি করেছিলাম। উনি ভাইপোর নামে দলিল করিয়েছিলেন। কথা ছিল, রিয়াজুল এলে রেজিষ্ট্রী হবে। রিয়াজুল একটু আগে এসেছিল। দলিল ফেরৎ দিয়ে বলল, ছেলে কী বাবার সম্পত্তি কিনতে পারে? এ বছর থেকে আপনার জমি আপনি চাষ করবেন। কত বড় উদার মনের ছেলে তোমরা দেখেছ? কথা বলতে বলতে কান্নায় তার গলা বুজে এল। সামলে নিয়ে আসমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দু’দিন পর তুই বুঝতে পারবি, ওর মন কত উদার। তারপর আসমানের দিকে দু’হাত তুলে বললেন, আল্লাগো, তুমি তাড়াতাড়ি সে দিন আমাকে দেখাও, যে দিন আসমাকে রিয়াজুলের হাতে তুলে দেব।
.
মনোয়ার হোসেন মোসারেফ হোসেনের চাচাতো ভাই। বয়সে পাঁচ-সাত বছরের বড়। জমি জায়গা যা ছিল ভালো ভাবেই চলে যেত। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই। তিন মেয়ে। জমি বিক্রি করে তাদের বড় ঘরে বিয়ে দিতে গিয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। বিঘে খানেকের মতো জমি এখনো আছে। তার ফসলে ও অন্যের খেত খামারে কাজ করে স্বামী স্ত্রীর একরকম চলে যায়। অসুখ-বিসুখে মেয়ে জামাইরা কিছু কিছু সাহায্য করে। মোসারেফ হোসেনের পূর্বদিকে পুকুর পাড়ের অল্প দূরে তার দোচালা বেড়ার ঘর। আজ কাজ থেকে ফিরে এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছিলো।
এমন সময় রিয়াজুল উঠোনে এসে চাচা বলে ডাকল।
মনোয়ার হোসেন বিড়ি নিভিয়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, তুমি এসেছ?
রিয়াজুল সালাম বিনিময় করে বলল, বাইরে বসে কথা বলি চলুন।
মনোয়ার হোসেন বললেন, তাই চল, তারপর উঠোনের বাইরে লিচু গাছের তলায় এসে বললেন, এখানেই বসা যাক।
বসার পর রিয়াজুল বলল, চাচা, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। আপনি ছাড়া আর কেউ সমাধান করতে পারবে না।
কি যে বল বাবা। শুনেছি তুমি শিক্ষিত ছেলে। আর আমি হলাম পাড়া-গাঁয়ের মূর্খ মানুষ। আমি কী করে সমস্যার সমাধান করব?
আমি শিক্ষিত হলে কী হবে? বয়সে আপনার ছেলে মত। হাজার হোক আপনি মুরুব্বি। কথায় আছে, কোনো সমস্যায় পড়লে মুরুব্বি লোকের কাছে পরামর্শ নেবে। তা ছাড়া যে ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি, তা আপনার সাহায্য ছাড়া সমাধান হবে না।
তাই যদি মনে কর, তা হলে সমস্যাটা বল, যদি সম্ভব হয়, যেকোন সাহায্য করার চেষ্টা করব।
শুধু চেষ্টা করার কথা বললে চলবে না। আপনাকে কথা দিতে হবে আমাকে সাহায্য করবেন। আমার দৃঢ় ধারণা, আপনি সাহায্য করলে সমস্যার সমাধান হবেই।
তোমার বাপকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুক। আমার সঙ্গে তার খাতির ছিল। আমার দ্বারা যদি তোমার কোনো উপকার হয়, তা হলে কথা দিলাম, সাহায্য করব। এবার তোমার সমস্যাটা বল।
আপনি কী শুনেছেন, আসমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে?
হা বাবা শুনেছি। আসমার বাপ ও তোমার ছোট চাচার কাছে শুনেছি। তা ছাড়া তুমি তোমার বাপের বন্ধুর জন্য যা কিছু করছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
আচ্ছা চাচা, মতি কেমন ছেলে বলতে পারেন?
হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
সে কথা পরে বলছি। মতির কথা আগে বলুন।
মতি খুব ভালো ছেলে। ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় চাকরি করত। হঠাৎ করে বাপটা মারা গেল। চাকরি ছেড়ে সংসারের হাল ধরেছে।
আমি মতির সঙ্গে আসমার বিয়ে দিতে চাই।
মনোয়ার হোসেন খুব অবাক হয়ে বললেন, সে কি বাবা, তুমি আসমাকে বিয়ে করবে?।
করার তো কথা ছিল, কিন্তু কালকে জানতে পারলাম, ওরা দুজন একে অপরকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে। এখন আপনিই বলুন, আমাকে বিয়ে করে আসমা কী সুখী হবে? না আমি সুখী হব? আর মতিও খুব দুঃখ পাবে। আমরা তিনজনের কেউই সুখি হতে পারব। না। তাই মতির সঙ্গেই আসমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মনোয়ার হোসেন মতি ও আসমার সম্পর্ক জানে। বহুবার দু’জনকে নির্জন দুপুরে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসে গল্প করতে দেখেছেন। বেশ কয়েকবার মোসারেফ হোসেনের কানেও কথাটা তুলেছেন। তাই রিয়াজুল তাদের পছন্দের কথা বলতে কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না। বরং রিয়াজুলের মনের উদারতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন। তার প্রতি স্নেহ আরো বেড়ে গেল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রিয়াজুল বলল, কি হল চাচা, কি এত ভাবছেন?
কী আর ভাবব বাবা, তোমার মতো ছেলে এখনো দুনিয়ায় আছে, তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
আমার কথা বাদ দিন। ওদের ব্যাপারে কী করবেন বলুন। আমি নিজেই কথাটা মোসারেফ চাচাকে বলতে পারতাম। কিন্তু উনি যদি কথাটা শুনে উত্তেজিত হন, তা হলে আবার পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যাবেন। তাই উনি যাতে উত্তেজিত না হন, সেই রকম পরামর্শ দিয়ে আপনি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।