সে তখন দেখা যাবে। তোকে ভাবতে হবে না।
তুমি মতি ভাইয়ের রাগ মানাতে পেরেছ?
আসমা রেগে উঠে বলল, হ্যাঁ পেরেছি। তারপর বলল, এত উঁকিলি জেরা করছিস কেন? নে এবার শুয়ে পড়।
আরো কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে সালেহা ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আসমার চোখে ঘুম এল না। রিয়াজুল ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
.
সামসুদ্দিন মিয়া নামায পড়ে মমজিদ থেকে ফিরে ভাত না খেয়ে ভাইপোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে দেখে বললেন, ভাত না খেয়ে কোথায় গিয়েছিলে?
রিয়াজুল বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
খাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা-বাবাকে আসার জন্য চিঠি দিয়েছ?
রিয়াজুল মনে মনে বলল, তার আর দরকার নেই ছোট চাচা। মুখে বলল, কাজের ব্যস্ততায় দিতে পারিনি। কাল দেব। তারপর ঘুমাতে গিয়ে অনেক রাত ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করতেই আসমা ও মতির কথপোকথন মনে পড়তে লাগল। হঠাৎ তার বিবেক বলে উঠল, তুমি শিক্ষিত ও ধার্মীক ছেলে হয়ে এই সামান্য ব্যাপারে বিচলিত হচ্ছ কেন? তুমি তো তোমার আব্বার বন্ধুকে আব্বার মতো মনে করে ও আল্লাহর নবী (দঃ) এর বানী স্মরণ করে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য মোসারেফ হোসেনকে সাহায্য করছ। নিশ্চয় তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নয়? তার মেয়ের জন্য করলে তো তুমি আল্লাহ ও তাঁর নবী (দঃ) এর সন্তুষ্টি পাবে না। তা ছাড়া তুমি তো আসমাকে ভালবাসনি। মা-বাবা মনে কষ্ট পাবে ভেবে বিয়েতে মত দিয়েছ। আর আসমা ও মতি অনেক বছর আগে থেকে একে অপরকে ভালবাসে। সেই ভালবাসার মাঝখানে বাধা সৃষ্টি করা কী তোমার উচিত? তুমি কী ভুলে গেছ, সুখ-শান্তি ভোগে নয়, ত্যাগে। মনে রেখ, যারা প্রকৃত মুসলমান, তারা নিজের সুখ শান্তির চেয়ে অন্যের সুখ-শান্তির চিন্তা বেশি করে। তা ছাড়া আসমাকে বিয়ে করলে সবাই ভাববে, এই জন্যই তাদেরকে সাহায্য করছ। আল্লাহ রাজি থাকলে তোমার তকৃদিরে আসমার থেকে আরো ভালো মেয়েকে বউ হিসেবে পাবে। শুধু শুধু নিষ্পাপ ফুলের মতো দুটো ছেলে-মেয়েকে দুঃখের সাগরে ভাসিওনা। আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে যে মহৎ কাজে হাত দিয়েছে, তা যদি সম্পন্ন করতে পার, তা হলে আসমাকে বিয়ে করে যতটা না সুখ-শান্তি পেতে তার থেকে অনেক বেশি পাবে।
বিবেকের যুক্তির কাছে রিয়াজুল হেরে গেল। সিদ্ধান্ত নিল, সে নিজে মতির সঙ্গে আসমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে। তারপর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত দু’টো।
বিছানা থেকে নেমে অজু করে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে মোনাজাত করল, হে গাফুরুর রহিম, আমি তোমার একজন নাদান গোনাহগার বান্দা। ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস। আমি আমার ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ও তোমার হাবিব (দঃ) কে সন্তুষ্ট করার জন্য যে পথে অগ্রসর হয়েছি তা সফল করার তওফিক আমাকে দাও। শয়তানের চক্রে পড়ে আমি যেন পথভ্রষ্ট না হই। বিতাড়িত শয়তানের হাত থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমার সকল নেক মনস্কামনা পূরণ কর। তোমার পেয়ারা হাবিব (দঃ) এর উপর শতকোটি দরূদ ও সালাম। তাঁরই অসিলায় আমার এই দেওয়া কবুল কর। আমিন। মোনাজাত শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে রিয়াজুল ছোট চাচার কাছ থেকে মোসারেফ হোসেন চাচার জমির দলিল নিয়ে ফেরৎ দেওয়ার জন্য রওয়ানা দিল। পথে মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা হতে সালাম বিনিময় কলে বলল, চাচা, আপনার সঙ্গে আমার খুব দরকারী কথা আছে।
মনোয়ার হোসেন বললেন, এখন তো সময় নেই বাবা, কাজে যাচ্ছি। ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়ে যাবে। এশার নামাযের পর না হয় এস।
তাই আসব বলে রিয়াজুল আসমাদের পুকুর পাড়ে এসে দেখল, মোসারেফ হোসেন চাচা, হাঁটাহাঁটি করছেন। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো। তুমি এই কদিন আসনি কেন? তোমার খবর নেওয়ার জন্য জাহিদকে পাঠাবার কথা আসমাকে কাল রাতে বলে রেখেছিলাম।ও স্কুলে গেছে। ফিরে এলে পাঠাতাম।
রিয়াজুল বলল, আব্বার অংশের জমিগুলো মিউট্রেশান করার জন্য অফিসে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে। তাই আসতে পারিনি।
চল বাবা ঘরে গিয়ে বসি।
না চাচা, এখন সময় হবে না। পরে আবার আসব। তারপর দলিলটা পকেট থেকে বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, আপনার যে জমি ছোট চাচা আমার নামে কিনেছিলেন, এটা সেই দলিল। রেজিষ্ট্রী তো হয়নি। এখন আর রেজিষ্ট্রী করারও দরকার নেই। ছেলে কি তার বাবার জমি কিনতে পারে? আপনার জমি আপনারই থাক। এ বছর থেকে আপনিই ভোগ দখল করবেন।
মোসারেফ হোসেনের মনে হল, পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দিবা স্বপ্ন দেখছেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একসময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
রিয়াজুল বলল, কাঁদছেন কেন? আপনি কী মনে করছেন এই জমি আপনাকে দান করলাম? তা কখনো মনে করবেন না। ছেলে কী বাবাকে দান করতে পারে? চোখ মুছুন, নচেৎ ভাবব, আমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করতে পারেননি।
না বাবা না, আমি তা ভাবিনি। তোমাকে নিজের ছেলের থেকে বেশি মনে করি। তোমার মতো ছেলে যে মা-বাবা জন্ম দিয়েছেন তারা ধন্য। তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতবাসি করুন। তোমার মনের উদারতা দেখে চোখের পানি রোধ করতে পারিনি। আল্লাহ তোমাকে চিরসুখী করুন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, দলিল ফেরৎ দেওয়ার ব্যাপারটা তোমার ছোট চাচা জানেন?