রিয়াজুল বলল, ছোট চাচা, মোসারেফ চাচার জমির দলিল তো রেজেন্ত্রী হয়নি। সেটা আমাকে দেবেন। ওটা ফেরৎ দেব ভেবেছি।
সামসুদ্দিন বললেন, তোমার জিনিস তুমি ফেরৎ দেবে, তাতে আমি বাধা দেব না। বরং এখন ফেরৎ দেওয়াই ভালো মনে করি। যখন দিতে যাবে তখন চেয়ে নিও।
রিয়াজুল বাবার সম্পত্তি মিউট্রেশনের জন্য দরখাস্ত করে ঢাকা গিয়েছিল। সে ব্যাপারে এই দু’তিন দিন অফিসে ছুটাছুটি করেছে। তাই আসমাদের ওখানে যেতে পারেনি। আজ মসজিদে এশার নামায পড়ে রওয়ানা দিল। আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। তাই টর্চ লাইট নিয়ে বেরোয়নি। চাঁদের আলোয় হেঁটে আসছিল।
আসমাদের পুকুরটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। তার পূর্ব পাড় দিয়ে ওরা যাতায়াত করে। উত্তর পাড়ে ঘাট ও বাস্তু ভিটা। ঘাট থেকে বাস্তুটা বিশ-পঁচিশ হাত দূরে। পুকুরের চারপাশের পাড়ে নানারকম ফলের গাছ। জাম গাছটা ঘাটের কাছে পশ্চিম পাড়ে।
রিয়াজুল ঘাটের কাছাকাছি এসে আমাকে পশ্চিম পাড়ের দিকে যেতে দেখে একটা নারকেল গাছেল আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল, ওদের বাড়ির পিছনে ছোট বড় বাথরুমের ব্যবস্থা, এত রাতে ঐদিকে যাচ্ছে কেন? একটু পরে পুরুষ ছেলের গলা পেয়ে সন্দেহ হল। ভাবল, ছেলেটা মতি নয় তো?
অল্প একটু এগিয়ে নিশ্চিত হল। তারপর একটা আমগাছের আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগল।
তখন তার মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগে তাদের দু’জনের অনেকক্ষণ আলাপ করার ঘটনা। সেদিন মনে একটু যে সন্দেহ হয়েছিল, আজকের ঘটনায় তা দৃঢ় হল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। যে আসমাকে ফুলের মতো পবিত্র মনে করেছিল, সে কিনা। বাসি ফুল? ছি-ছি-ছি। যে রাতের অন্ধকারে প্রেমিকের সঙ্গে অভিসার করে, তাকে পবিত্র ভেবে বিয়ে করতে যাচ্ছি? না-না, এ কখনই সম্ভব নয়। চিন্তা করতে লাগল, তার এখন কী করা উচিত।
মোসারেফ হোসেন মেয়েকে কিছু বলার জন্য স্ত্রীকে বললেন, আসমাকে ডাক তো।
মাহমুদা বিবি পাশের রুমে গিয়ে সালেহা ও জাহিদকে পড়তে দেখে সালেহাকে জিজ্ঞেস করলেন, আসমা কোথায়?
সালেহা মাকে দেখে বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, বুবু এক্ষুণি বাথরুমে গেল।
বাথরুম থেকে এলে বলিস, তোর আব্বা ডেকেছে। কথা শেষ করে মাহমুদা বিবি চলে গেলেন।
সালেহা তাড়াতাড়ি বুবুকে ডাকতে গেল।
কারো আসার শব্দ পেয়ে রিয়াজুল ঘাটের দিকে আসার সময় সালেহাকে দেখে বলল, এত রাতে এদিকে কোথায় যাবে?
সালেহা তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো উত্তর দিতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।
রিয়াজুল বুঝতে পারল, সালেহা ওদের অভিসারের কথা জানে। দেরি হচ্ছে বলে হয়তো বুবুকে ডাকতে এসেছে।
সালেহা আমতা আমতা করে বলল, আমি ঘাটে এসেছি। আপনি এদিকে কি করছিলেন।
আমি তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। এদিকে কারা যেন কথা বলছে শুনে দেখতে যাচ্ছিলাম। যাক গে চলি, আজ আর যাব না। কাল সকালে আসব বলে রিয়াজুল চলে গেল।
রিয়াজুল চলে যাওয়র পর সালেহা জামগাছের কাছাকাছি এসে বলল, বুবু তোমাকে আব্বা ডাকছে।
আসমা মতিকে বলল, কাল এই সময়ে এস। তারপর এগিয়ে এসে সালেহাকে বলল, চল।
আমগাছের কাছে এসে সালেহা বলল, রিয়াজুল ভাইকে এখানে দেখলাম। আমাকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে এদিকে কোথায় যাবে?
আসমা চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, কী বলছিস তুই?
হা বুবু।
তার কথার উত্তরে তুই কী বললি?
বললাম, আমি ঘাটে এসেছি। তারপর বললাম, আপনি এখানে কী করছিলেন? জবাবে উনি বললেন, তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। বুবু, আমার মনে হয় উনি তোমাদের কথাবার্তা শুনেছেন।
রিয়াজুল ভাই আমাদের ঘরে গেছেন?
না। বললেন, কাল সকালে আসবেন।
ততক্ষনে তারা উঠোনে চলে এল। আসমা তাকে যেতে বলে আব্বার কাছে এল। তার বুক ভয়ে তখনওঁ ধক ধক করছে। ঘরে ঢুকে যথাসাধ্য সংযত করে বলল, আমাকে ডেকেছ আব্বা?
মোসারেফ হোসেন বললেন, এই ক’দিন রিয়াজুল এল না কেন বলতে পারিস?
হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছেন। কাল আসবেন বলতে গিয়েও সামলে নিল।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়! কাল সকালে না হয় জাহিদকে ডাকতে পাঠাস।
ঠিক আছে, পাঠাব।
আজ তিন-চারদিন হয়ে গেল ছেলেটা এল না। কোনো অসুখ-বিসুখ করল কিনা কে জানে।
কাল জাহিদকে পাঠালে খবর পাওয়া যাবে।
তা অবশ্য যাবে। কি জানিস মা, এই ক’দিন ছেলেটাকে না দেখে বড় খারাপ লাগছে। ঠিক আছে, যা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
আসমা খেয়ে রুমে এসে দেখল, জাহিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সালেহা মশারী খাটাচ্ছে।
বুবুকে দেখে সালেহা জিজ্ঞেস করল, আব্বা ডেকেছিল কেন?
রিয়াজুল ভাই ক’দিন আসেনি কেন জিজ্ঞেস করে বলল, কাল সকালে ডেকে আনার জন্য জাহিদকে পাঠাস।
ছোট বাথরুমের কাজ সেরে এসে দু’বোনে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কারো চোখে ঘুম এল না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে সালেহা বলল, বুবু তুমি ঘুমিয়েছ?
আসমা বলল, নারে, ঘুম আসছে না। তুই ঘুমাসনি কেন?
আমারও ঘুম আসছে না। রিয়াজুল ভাই যদি সত্যি সত্যি তোমাদের কথাবার্তা শুনে থাকে, তা হলে কি হবে ভেবে ভয় ভয় করছে।
তোর ভয় করবে কেন? করলে আমার করবে। শোন, তোকে যদি রিয়াজুল ভাই। আজকের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবি, তুই কিছু জানিস না।
আর তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী বলবে?