আজ সকালে জাহিদের ছেঁড়া জামাটা সেলাই করার সময় মতির কথা ভাবছিল। প্রায় ছ’মাস হতে চলল ঢাকায় চাকরি করতে গেছে। নতুন চাকরি বলে ছুটি পায়নি। তাই আসতে পারেনি। সে কথা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। এপর্যন্ত আসমা তার পাঁচটা চিঠি পেয়েছে। এমাসে এখনো পায়নি। রান্না ঘর থেকে মায়ের ডাক শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
আসমা…. ও আসমা, কোথায় গেলিরে মা?
আসমা জামাটা সেলাই করতে করতেই মায়ের কাছে এসে বলল, কেন ডাকছ বল।
মাহমুদা বিবি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোর আব্বার হাত-পায়ের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ওষুধ না কিনলেই নয়। ঘরে এক মুঠো চালও নেই।
তারপর দু’গাছা সোনার বালা তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, তুই এক্ষুণি বালিয়াকান্দি যা। তোর বড় মামাকে এ দুটো বিক্রি করে টাকা দিতে বলবি।
ততক্ষণে জামাটা সেলাই হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে সুতো কেটে বালা দুটো নিয়ে বলল, বিয়ের চিহ্ন সবকিছুই তো বিক্রি করে দিলে, এ দু’টেও করবে? আব্বা এ দুটো বিক্রি করতে নিষেধ করেছিলেন না?
আস্তে বল, তোর আব্বা শুনতে পাবে। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই তো জানিস, এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।
তা তো জানি; কিন্তু এই টাকায় কত দিন আর চলবে? তারপর কি করবে ভেবে দেখেছ?
মাহমুদা বিবি আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবে আর কী করব মা, আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। তুই আর দেরি করিস না। এতটা পথ যেতে আসতে অনেক সময় লাগবে।
জাহিদের আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে এসে মাকে সালাম করে আসমাকে করার সময় বলল, বড় বুবু জামা সেলাই হয়েছে? পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে তো।
হাঁ হয়েছে, বলে আসমা জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে সালাম করেছিস?
হ্যাঁ করেছি।
আসমা জামাটা পরিয়ে দিয়ে বলল, পরীক্ষা শুরু হতে দেরি আছে, একটু দাঁড়া আমিও তোর সঙ্গে যাব। কথা শেষ করে রুমে এসে শাড়িটা ঠিক করে পরার সময় বালা দুটো পেট কাপড়ে জড়িয়ে নিল। তারপর মুখে হাতে একটু নারকেল তেল মেখে মাথায় দু’একবার চিরুনী বুলিয়ে বেরিয়ে এসে জাহিদকে বলল, চল।
আসার সময় বারান্দার তার থেকে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল।
যেতে যেতে জাহিদ বলল, তুমি স্কুলে যাবে কেন বড় বুবু?
আসমা বলল, স্কুলে যাব না, মামাদের ওখানে যাব।
অত দূরের রাস্তা তুমি একা যাবে? কাল আমার পরীক্ষা নেই, কাল গেলে হত না? আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম।
না, পরীক্ষার সময় তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। বিশেষ দরকারে আব্বা পাঠালেন। বড় মামার সঙ্গে দেখা করেই চলে আসব।
এ বছর ক্লাসে ওঠার পর আমাকে নতুন প্যান্ট-জামা কিনে দিতে হবে কিন্তু।
দেব রে দেব, তোকে কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।
ফার্স্ট হব কি করে? আমার তো প্রাইভেট মাস্টার নেই। জান বড় বুবু, মিয়া বাড়ির রসিদ দু’টো মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, ওর সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারব?
কেন পারবি না, আমি তো তোকে সব সাবজেক্ট পড়াই। আমার মন বলছে, ইনশাআল্লাহ তুই ফার্স্ট হবি।
স্কুলের কাছে এসে আসমা বলল, ধীর স্থিরভাবে পরীক্ষা দিবি। তাড়াহুড়ো করবি না। প্রথমে প্রশ্নপত্র পুরোটা পড়বি। তারপর যে গুলো সহজ মনে হবে সেগুলোর উওর আগে লিখবি। ঘন্টা পড়ার আগে যদি সব উত্তর লেখা হয়ে যায়, তা হলে বসে বসে রিভাইজ দিবি। তারপর তাকে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে আসমা হাঁটতে শুরু করল।
তার মামাদের বাড়ি বালিয়াকান্দী, জয়নগর থেকে প্রায় চার মাইল। তার মামারা তিন ভাই। সবাই ভিন্ন। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক। ছোট দু’জনের পাঁচ-ছটা ছেলে মেয়ে। চাষবাস করে কোনোরকমে সংসার চালায়। বড় জনের নাম আনোয়ার হোসেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের ঘরে চার বছরের এক নাতি। তার নাম রহিম। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় জনের অবস্থা একটু স্বচ্ছল। তিনি মাঝে মধ্যে একমাত্র বোনের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেন। যতটুকু পারেন টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।
আসমা যখন মামা বাড়ি এসে পৌঁছাল তখন বেলা এগারটা।
আনোয়ার হোসেন বাড়িতে ছিলেন। ভাগনিকে দেখে বললেন, কিরে খবর সব ভালো তো?
আসমা সালাম বিনিময় করে মামা মামিকে কদমবুসি করল। তারপর বলল, জ্বি ভালো বলে পেট কাপড় থেকে বালা দুটো বের করে মামার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো মা বিক্রি করে টাকা দিতে বলেছে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে।
আনোয়ার হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, মারে, আমি এমনই হতভাগা, তোদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তোর মা এক এক করে সব গহনা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। আল্লাহ যে তোদের তকদিরে কি রেখেছেন তা তিনিই জানেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ওকে কিছু খেতে দাও, আমি এগুলো বিক্রি করে আসি। কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
বড় মামি হুসনে আরা আসমাকে বললেন, এখন মুড়ি টুড়ি কিছু খাবি, না একেবারে ভাত খাবি?
আসমা বলল, না বড় মামি এখন কিছু খাব না। একেবারে ভাত খাব। ভাবি কোথায়?
সে রান্না ঘরে।
আসমা রান্না ঘরে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ভাবী কেমন আছ?
জুলেখা তরকারী কুটছিল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আরে আসমা যে, কেমন আছ? ফুফা ফুপি ভালো আছেন? তারপর একটা পিঁড়ে এগিয়ে দিয়ে বলল, বস।