আসমা তার পিছন পিছন এসেও ধরতে পারল না। পুকুর পাড়ে এসে বলল, মতি ভাই। দাঁড়াও, কথা আছে।
মতি শুনেও না শোনার ভান করে চলে গেল।
আসমা এতক্ষণ সামলাতে পারলেও এখন আর পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানতে পারল না। সালেহা এসে যখন বলল, বুবু তোমাকে আব্বা ডাকছে তখন হুঁস হল। চোখ মুখ মুছে বলল, হ্যাঁ চল।
যেতে যেতে সালেহা বলল, মতি ভাই রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে।
শুধু কষ্ট পায়নি, খুব রেগেও গেছে। দেখলি না, আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
ততক্ষণে তারা উঠোনে এসে গেছে। মোসারেফ হোসেন আসমার নাম ধরে ডেকে বললেন, আমার কাছে আয়।
আসমা সালেহাকে মায়ের কাছে যেতে বলে আব্বার কাছে এল।
মোসারেফ হোসেন নরম সুরে বললেন, তুই আর মতির সঙ্গে মেলামেশা করবি না। সে। এলে যতটুকু কথা না বললে নয়, ততটুকু বলবি। আল্লাহ এখন আমাকে সুস্থ করেছেন। দরকারী কথা আমিই মতির সঙ্গে বলব। এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে বেড়াবি না। কিছুদিনের মধ্যে তুই মিয়া বাড়ির বৌ হবি। সেই বুঝে চলাফেরা করবি। তোর মা বলছিল, এই ক’দিন তুই নাকি একদম খাওয়া-দাওয়া করিসনি? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো?
না আব্বা, আমার কিছু হয়নি। তুমি চিন্তা করো না।
তোকে যতদিন না রিয়াজুলের হাতে দিতে পারছি ততদিন নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আল্লাহ যেন ভালই ভালই কাজটা মিটিয়ে দেন। এবার যা আমার গোসলের পানি দে, যোহরের আযানের সময় হয়ে এল।
কিসের জন্য যেন স্কুল কয়েকদিন বন্ধ। দুপুরে খেয়ে উঠে জাহিদ ঘুমাল। আর সালেহা আসমাকে বলল, অনেক অংক পারিনি, সেগুলো বুঝিয়ে দাও।
আসমা বলল, বই খাতা বের কর।
সালেহা ঘরের মেঝেতে পাটি মেলে বই খাতা নিয়ে বসল।
আসমা তার পাশে বসে বলল, বই খুলে দেখা কোন অংকগুলো পারিস নি।
সালেহা অংকের বই খুলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, বুবু তিন রাত পার হয়ে গেল, স্বপ্ন। দেখনি?
আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখেছি। তোর শোনার দরকার নেই।
বল না বুবু, আল্লাহর কসম কাউকে বলব না।
কথায় কথায় আল্লাহর কসম কাটিস কেন? আমি কী তোকে কসম কাটতে বলেছি?
ঠিক আছে, আর কাটব না। কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি বল।
শোন, স্বপ্নের কথা বড় আলেমের কাছে ছাড়া কারো কাছে বলতে নেই। তা ছাড়া তিন দিনের আগে বলাও নিষেধ। তিন দিন পর মসজিদের ইমাম হুজুরের কাছে তোকে সাথে করে নিয়ে যাব স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য, তখন শুনিস। এখন অংক বুঝে নে।
আসরের আযান হতে আসমা বলল, বাকিগুলো কাল বুঝিয়ে দেব। তারপর জাহিদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলল, উঠ আযান হয়ে গেছে। অজু করে আমার সঙ্গে দেখা করে নামায পড়তে যাবি।
জাহিদ অজু করে এলে আসমা বলল, মতি ভাই মসজিদে নামায পড়তে এলে তাকে বলবি, আজ রাত নটার সময় অতি অবশ্যই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। আমি পুকুর পাড়ের জাম গাছের তলায় থাকব। আর যদি সে মসজিদে না আসে তবে তাদের ঘরে গিয়ে তাকে বলে আসবি।
ঠিক আছে বলব বলে জাহিদ নামায পড়তে মসজিদে গেল। নামায পড়ে বেরোবার সময় মতি ভাইকে দেখে বুবুর কথা বলল।
মতি শুনে রেগে গিয়ে কিছু না বলে চলে গেল।
জাহিদ ফিরে এলে আসমা জিজ্ঞেস করল, কিরে, মতি ভাই নামায পড়তে এসেছিল?
হা। যা বলতে বলেছিলে বলেছি।
শুনে কিছু বলেনি?
না। বলে জাহিদ খেলতে চলে গেল।
এশার নামায পড়ে আসমা সালেহাকে বলল, আমি পুকুর পাড়ের জাম গাছতলায় যাচ্ছি। জাহিদকে দিয়ে মতি ভাইকে এই সময়ে আসতে বলেছি। আব্বা ডাকলে আমি নামায পড়ছি বলে আমাকে খবর দিবি। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জাম গাছের নিচে অপেক্ষা করতে লাগল।
জাহিদের মুখে আসমা ডেকেছে শুনে মতি প্রথমে খুব রেগে গিয়ে যাবে না ভেবেছিল। পরে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, গিয়েই দেখা যাক, আসমা কী বলে।
এশার নামায পড়ে মতি জাম গাছ তলায় এসে দেখল, আসমা দাঁড়িয়ে আছে। বলল, কেন ডেকেছ বল?
আসমা বসে পড়ে তার দু’পায়ে দু’টো হাত রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, বিশ্বাস কর মতি ভাই, ঢাকায় থাকাকালীন আমি এ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। ঘরে এসে আব্বা আমাকে বলেছে। শোনার পর থেকে আমি যে কী যন্ত্রণায় ভুগছি তা আল্লাহকে মালুম। একদিকে তুমি, আর অন্যদিকে আব্বার জীবন। তারপর ডাক্তার যা বলেছিলেন বলে বলল, তুমি আমাকে বিষ এনে দাও, খেয়ে এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাই।
আসমার কথা শুনে তার প্রতি মতির যে রাগ ছিল, তা পড়ে গেল। হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে তার চোখ-মুখ মুছিয়ে দেওয়ার সময় বলল, তুমি বিষ এনে দেওয়ার কথা আমাকে বলতে পারলে? যন্ত্রণা তুমি একা ভোগ করছ? আমি করিনি? বিষ খেলে দুজনে একসঙ্গে খাব।
আসমা চমকে উঠে ভিজে গলায় বলল, না মতি ভাই, না। তা হলে আব্বা আবার পঙ্গু হয়ে যাবে, অথবা হার্টফেল করে মারা যাবে। যদি ডাক্তার ঐ কথা না বলতেন, তা হলে আব্বার মুখে রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার রাত্রেই এই জীবন শেষ করে দিতাম। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
রিয়াজুল ঢাকা থেকে ফিরে এসে ছোট চাচা-চাচিকে আসমার সম্বন্ধে মা-বাবার ইচ্ছার কথা জানাতে তারা শুনে খুশি হয়ে বললেন, এতে খুব ভালো কথা। তুমি তাদেরকে চিঠি লিখে তাড়াতাড়ি আসতে বলে দাও। এসব কাজে দেরি করতে নেই।